রমেন দাস: বাবা তোর কী হয়েছে! তুই এমন করছিস কেন! জীবনের শেষরাতে স্বপ্নদীপের মায়ের কণ্ঠে একথাই শুনেছিলেন নদিয়ার রামপ্রসাদ কুণ্ডু। ফোন লাউড স্পিকারে থাকায় ছেলের আর্তনাদ শুনেছিলেন বাবা, ভাইও। কিন্তু পারেননি! ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি ওঁরা। মুহূর্তেই তছনছ হয়েছে সব।
বৃহস্পতিবার ভোররাতে যাদবপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর (Swapnadip Kundu) । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Jadavpur University) হস্টেলের ব্যালকনি থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ওই ছাত্রের। কিন্ত বাংলা সাম্মানিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপের মৃত্যু নিয়ে ঘনিয়েছে একাধিক রহস্য। উঠে এসেছে বহু প্রশ্নও। এবার এই বিষয়েই বিস্ফোরক তাঁর বাবা। নদিয়ার বগুলার বাসিন্দা স্বপ্নদীপের বাবা রামপ্রসাদ কুণ্ডুর (Ramprasad Kundu) সঙ্গে সংবাদ প্রতিদিন-র কথোপকথনে উঠে এল একাধিক বিস্ফোরক অভিযোগও। ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? কাদের ‘অত্যাচারে’ মরতে হয়েছে ওই ছাত্রকে? কেন হস্টেল চত্বরেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলেন স্বপ্নদীপ?
সেদিন ঠিক কী হয়েছিল? কেন খুনের অভিযোগ করছেন আপনারা?
রামপ্রসাদ: সেদিন বুধবার ছিল। আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার ছোট ছেলে বাড়িতে ছিলাম। সেদিন ছেলে (স্বপ্নদীপ) সারাদিন ফোন করেনি। ওর মা-ও চেষ্টা করছিল যোগাযোগের। অবশেষে ফোনে কথা হয় ওর সঙ্গে। কিন্তু চমকে যাই আমরা! দেখি ছেলে আমার হাহাকার করছে! আমি ভাল নেই! বারবার একথা বলছে। ফোন লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিল। সেই আর্তনাদ আমরা শুনছি।
তারপর?
রামপ্রসাদ: (কান্না ভেজা গলায়) ওর মা বলছে বাবা তোর কী হয়েছে! তুই এমন করছিস কেন! তখনই ভাবি, ছেলে আমার ভাল নেই! ওখানে আর রাখব না ভাবতে থাকি। বাড়ি নিয়ে আসব, অন্য জায়গায় ভর্তি করাব। শুক্রবার যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু..
কিন্তু কী?
রামপ্রসাদ: রবিবার হস্টেলে (Jadavpur University Main Hostel) গিয়েছিল। তারপর ওর মনখারাপ ছিল । বুঝতে পারছিলাম না কেন। ভেবেছি নতুন জায়গা তাই হয়ত!
কেন এভাবে মারা হবে স্বপ্নদীপকে! আপনারা বারবার খুনের অভিযোগ কেন করছেন?
রামপ্রসাদ: আমি নিশ্চিত, আমার ছেলেকে খুন করা হয়েছে। র্যাগিং করে মেরেছে! ছেলেকে ফেলে মেরে দিয়েছে। আমার নিষ্পাপ, সরল সাধাসিধে ছেলেটাকে শেষ করে দিল ওরা!
[আরও পড়ুন: ‘JU হস্টেল নিয়ে রোমান্টিসিজম ছিল’, স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পর বিস্ফোরক আরেক ছাত্র]
ওঁরা মানে, কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন আপনি?
রামপ্রসাদ: ওরা দু’জন, মানে রঞ্জন চৌধুরী (নাম পরিবর্তিত) আর শুভজিৎ (নাম পরিবর্তিত)।
এঁরা কারা? কেন এঁদের কথা বলছেন আপনি?
রামপ্রসাদ: ওরা ওই হস্টেলেই থাকে। একজন শুনেছি পড়াশোনা শেষ হলেও ওখানে থাকে। ওরা খুনি, আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলল!
কেন বলছেন একথা?
রামপ্রসাদ: আমার ছেলে হস্টেলে থাকার জন্য প্রথম ১৭ জনের মধ্যে সুযোগ পায়নি। ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। এরপর ওরা (অভিযুক্ত দু’জন) আমাদের বলেন, চিন্তা নেই আমরাই রেখে দেব। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু তখন তো বুঝিনি!
কী না বোঝার কথা বলছেন?
রামপ্রসাদ: মাত্র কয়েকদিন! র্যাগিং করেছে ওরা। অত্যাচার করেছে ছেলেকে। বারাবার সেই কষ্ট সহ্য করতে পারছিল না ও।
শারিরীক নির্যাতনের কথাও বলছেন?
রামপ্রসাদ: হ্যাঁ। আমার ছেলেকে ওরা মেরেছে। রড দিয়েও মেরেছে, অকথ্য নির্যাতিন করেছে। ওদের সবাই ভয় পায়! বিবস্ত্র করেছে ওরাই!
কেন এসব করা হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
রামপ্রসাদ: মারল তার কারণ, ওদের কুকীর্তি সকলে জেনে যাবে তাই। ওরা নোংরামি করে। সবসময় র্যাগিং, অত্যাচার চলে ওই হস্টেলে। যদি বাইরের সবাই সব জেনে যায়, আমার ছেলে বলে দেয় সব! এই কারণেই স্বপ্নদীপকে খুন করা হয়েছে। কেউ যেন ওদের নষ্টামি জানতে না পারে!
সেদিন কখন জানতে পারলেন?
রামপ্রসাদ: জানেন, আমার ছেলেকে ফেলে দেওয়ার পরেও কেউ ধরেনি! অনেকক্ষণ ও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েই ছিল। পরে কয়েক জন এসে ওকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। তারপর জানতে পারি…! (বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন রামপ্রসাদ)
(প্রশ্ন থামিয়ে দিয়ে…)
রামপ্রসাদ: আমি বলছি, ওকে রড দিয়েও মেরেছে! ওর পায়ে দাগ! শরীরের একাধিক জায়গায় মারের দাগ ছিল। স্মশানে গিয়ে আমার আত্মীয়রা দেখেছেন সেই দাগ। ইচ্ছা করে দেরি করেছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এটাকে সুইসাইড কেস হিসাবে দেখানোর চক্রান্ত করেছে কেউ কেউ!
[আরও পড়ুন: বাবাকে খুনের পর আত্মঘাতী ছেলে! স্কুলে মিলল জোড়া দেহ, ঘনীভূত রহস্য]
চিকিৎসা নিয়ে কোনও অভিযোগ করছেন?
রামপ্রসাদ: ওই হাসপাতালের (যাদবপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল) চিকিৎসকরা আমার ছেলের গায়ের দাগগুলো দেখাতে পারতেন আমাকে! আমি দেখতাম। কেন, কী কারণে আমার ছেলের সঙ্গে ওরা (অভিযুক্ত) এমন করল!
কিছু টের পেলেন না! কেন ব্যবস্থা নিলেন না আগেই?
রামপ্রসাদ: এত তাড়াতাড়ি সব শেষ হবে কে জানত বলুন! আমার ছোট ছেলে, ক্লাস টেনে পড়ে। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল। ও বলছিল, ওই হস্টেলের ছেলেগুলোর আচরণ নাকি ওর ভাল লাগেনি প্রথমেই। কেন যে রেখে এলাম! এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে!
কোনও গ্রেফতার অথবা তদন্তের বিষয়ে কিছু জানতে পেরেছেন?
রামপ্রসাদ: পুলিশ (Kolkata Police) আমাদের এই বিষয়ে এখনও কিছু জানিয়েছে কিনা, আমি জানি না। তবে শাস্তি হোক ওদের। খুনিদের বিচার হোক। পুলিশ আরও তাড়াতাড়ি সব করুক। আর পারছি না। অভিযোগ দায়ের করেছি। শাস্তি চাই। শুধু শাস্তি চাই ওদের।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। কী কথা হল ওঁর সঙ্গে?
রামপ্রসাদ: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ফোন করেছিলেন আমাকে। তিনি বলেছেন, এই ঘটনায় দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হবে! আমি আমার ছেলের খুনের, মৃত্যুর বিচার চেয়েছি তাঁর কাছে। আর কী চাইব বলুন!