ডা. শংকর সেনগুপ্ত: “দামোদর শেঠ অল্পেতে খুশি হত না। খাই খাই বাতিক ছিল।” রবি ঠাকুরের সেই পদ্য কি শুধু কবিতার বইতেই রয়ে গিয়েছে? যদি আমি আপনি বা আমাদের কিছু সহনাগরিক দিনে একবারও ভাবতেন তাহলে হলফ করে বলতে পারি, যে কোনও রকমের ক্যানসার অর্ধেক কমত। কিন্তু তেমনটা আর হয় কোথায়? তাই হাসপাতালে যত ধরনের রোগী নিত্য আসেন তাঁদের একটা বড় অংশ কোনও না কোনও ক্যানসারে আক্রান্ত এবং রোগের শিকড় সেই খাবার অথবা যে কোনও রকমের পানীয়।
ক্যানসারের সঙ্গে বিভিন্ন খাবার-দাবারের সম্পর্ক আছে। দেখা যায়, আমরা যেসব খাবার খেতে ভালবাসি না সেগুলি প্রায় সবক’টাই কিন্তু শরীরের জন্য উপকারী। পলিফেনল, বিটা ক্যারোটিন, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি যুক্ত খাবার ক্যানসার রুখতে সাহায্য করে। কিন্তু এই পদার্থগুলি যেসব খাবারে আছে সেইগুলোই আমরা খাই না।
আবার এমন কিছু খাবার আছে যেগুলোতে অরুচি হয় না বললেই চলে। কিন্তু ওইসব খাবারই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। কারণ ওই খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে এমন কিছু পদার্থ থাকে যার সঙ্গে ক্যানসারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এই সুযোগে আমি বেশ কিছু খাবারের কথা বলতে পারি যেগুলি গত কয়েক বছরে প্রচুর পরিমাণে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়িতে রাখা হয়। যেগুলি ক্যানসারের ঝুঁকি প্রচুর পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। এগুলির মধ্যে জাঙ্ক ফুড অথবা ফ্রোজেন ফুড প্রায় সব মধ্যবিত্তের বাড়ির ফ্রিজে প্রায় নিয়ম করে রাখা থাকে।
অন্যদিকে রেডমিট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এমনটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। বিশেষ করে যে কোনও রকম প্রক্রিয়াজাত মাংসই শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। যেমন গরু, খাসি, শুয়োর, ভেড়ার মাংসের মতো রেডমিট। আরও মারাত্মক হল হটডগ, সালামি, বেকন, হ্যাম, লাঞ্চমিট যেগুলি হামেশা আমাদের ফ্রিজে রাখা থাকে এবং খিদে পেলেই আমরা গরম করে খেয়ে নিই। এগুলি কিন্তু ক্যনাসরারে ঝুঁকি অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। তাই বলা হয় যে কোনও ধরনের প্রক্রিয়াজাত মাংস না খাওয়াটাই উচিত।
এ তো গেল প্রক্রিয়াজাত মাংসের কথা। কিন্তু অপ্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন তাজা মাছ, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন পনিরও কিন্তু সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। তথ্য বলছে, এই ধরনের খাবারও কিন্তু সপ্তাহে ১৮ আউন্স বা ৫১০ গ্রামের বেশি খাওয়া শরীরের পক্ষে ঠিক নয়। আবার উলটো দিকে দেখুন যে কোনও রকমের সবজিই কিন্তু ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। বিশেষত বিভিন্ন রঙের সবজি যেমন গাজর, ক্যাপসিকাম, ব্রকোলি, সবুজ টাটকা যে কোনও সবজি রোজ খান। আর নিয়মিত ভিটামিন সি যুক্ত একটা করে ফল খান। লেবু, আমলকী খুব উপকারী। বিভিন্ন দানাশস্য যেমন তিল, তিসিতে ক্যানসার প্রতিরোধক উপাদান রয়েছে। এছাড়া সে সব খাবার যেগুলিতে ভিটামিন সি, এ, ডি, বি অথবা মাল্টিভিটামিন রয়েছে সেগুলি খেলেও ক্যানসার প্রতিরোধ হবে। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন, বলা হয় এটি পলিপ ক্যানসার কমাতে সাহায্য করে। তবে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট না খেয়ে সবজি অথবা বিভিন্ন ধরনের ফল খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে।
শুধু মাছ, ডিম, মাংসের মধ্যে বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ না করে আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। তবেই ক্যানসার থেকে অনেকটা দূরে থাকা সম্ভব। যেমন বেশি পরিমাণে নিয়মিত অ্যালকোহল খাওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। অ্যালকোহল কিন্তু শরীরে ক্যানসারকে ডেকে আনে। আর শুধু অ্যালকোহলই বা বলি কেন? যে কোনও রকমের পানীয়, সোডা যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে কৃত্রিম সুগার ও ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে সেগুলি থেকেও ক্যানসারের সম্ভবনা রয়েছে।
[আরও পড়ুন: অমলেট, সিদ্ধ ডিম না পোচ, কোনটা খাওয়া বেশি উপকারী? জানালেন বিশেষজ্ঞ]
খাবার,পানীয়র কথা তো বললামই। আর একটা কথা না বললেই নয়,প্যাকেটে বড় বড় করে লেখা থাকে ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু এটা মানে ক’জন? কলেজের গণ্ডি ছাড়াবার আগেই সিগারেটের সুখটান অনেকটা হিরো হওয়ার সাধ এনে দেয়। এটা শুধু ছেলেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এমনটা কিন্তু নয়। হালফিলে মেয়েদের মধ্যেও ধূমপানের প্রবণতা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। সিগারেট, বিড়ি, গুটখা,পানমশলা অর্থাৎ তামাক জাতীয় যে কোনও নেশাই ক্যানসার ডেকে আনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, তামাক জাতীয় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর পরিমাণ বিশ্বে ২১ শতাংশ। এ রাজ্যে মোট ক্যানসার রোগীর ২৭ শতাংশই তামাকজাতীয় ক্যানসারে আক্রান্ত। এর মধ্যে, ফুসফুস, ঠোঁট ও জিভের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যাটা সর্বাধিক।
দ্বিতীয় সারিতে রয়েছে পুরুষ ও মহিলাদের স্তন ক্যানসার। বিশেষজ্ঞরা এখানেও বলছেন, লাইফস্টাইল কিছুটা বদল করলে এ বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আচমকা শরীরের কোনও জায়গা ফুলে যাওয়া, ব্যথা অথবা দীর্ঘ সময় অবশ হয়ে থাকার মতো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে শুরুতেই এই রোগ ধরা পড়লে সুস্থ হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
একটা কথা বলে শেষ করি, যে কোনও ভাজাভুজি, দুষ্পাচ্য খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা যায় ততই ভাল। ধূমপান, মদ্যপান না করেও সামাজিক অনুষ্ঠানে হাজির থাকা যায়। মানুষের সৌন্দর্য তাঁর ব্যক্তিত্বে, নেশা আসক্তিতে নয়।
অধ্যাপক ডা. শংকর সেনগুপ্ত
চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের উপাধ্যক্ষ