মানসিক অবসাদের অতিমারী ঠেকাতে ধ্যান বা মেডিটেশন ভ্যাকসিনের ভূমিকা নিতে পারে। শুধু ট্রান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশনের কার্যকারিতা নিয়ে ছশো সায়েন্টিফিক পেপার আছে। তবে চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, হরমোনের খেলাতেই মেজাজ খারাপ হয়। তাই ধ্যানের আগে সেরোটোনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। ওষুধ খেয়ে মেজাজ ঠিক করে তারপর বসতে হবে ধ্যানে। তবেই মিলবে সুফল। লিখলেন গৌতম ব্রহ্ম।
শুভব্রত ভট্টাচার্য যোগ বিশেষজ্ঞ: ধ্যান হল আমাদের ভিতরের নিস্তব্ধতাকে অনুভব করার একটি যৌগিক পদ্ধতি। আমরা বাইরের শব্দ শুনে, চোখে কিছু দেখে প্রতিক্রিয়া দিই। আর ধ্যানের মাধ্যমে শরীর-মনের ভিতরে চলা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করি। ধ্যানের ক্ষেত্রে অন্তরমন বা ট্রান্সেডেন্টাল মেডিটেশেন খুবই কার্যকরী। এতে মানসিক অবসাদ, হতাশা খুব দ্রুতি কাটিয়ে ওঠা যায়। মন এক চতুর্থ আয়ামে চলে যায়। যেখানে চিন্তার ঢেউ নেই। অন্যভাবে বলা যায় চিন্তাশূন্য অবস্থায় পৌঁছই আমরা। হিমালয়ের সাধকদের মধ্যে এই ধ্যান পদ্ধতি অপরিচত নয়। তবে সাধারণ মানুষের সামনে এই পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করেন মহর্ষি মহেশ যোগী।
হিমালয়ের এই গুপ্ত সাধক গুরুর দেহত্যাগের পর ১৯৫২ সালে ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটিশেন বা টিএম-এর শিক্ষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এক আন্দোলন সংগঠিত করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। আন্দোলন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় ১৯৬০ সালে, যখন বিটলস এবং অন্যান্য অনেক সেলিব্রিটি এই টিএম-আন্দোলনে শামিল হন। টিএম দিনে দুবার অনুশীলন করা হয়। যেখানে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে মানসিক ক্রিয়াকলাপ কমিয়ে চেতনার উচ্চতর স্তরে পৌঁছনোর চেষ্টা হয়। টিএম-এর ধাঁচেই এদেশে প্রচলিত ‘অন্তরমন’ মেডিটেশন। এখানেও অনবরত পর্যবেক্ষণের মাধমে মনকে শান্ত করা হয়, চিন্তাশূন্য করার চেষ্টা হয়। পর্যায় আলাদা হলেও পদ্ধতিগত মিল রয়েছে সব ধ্যানের প্রক্রিয়াতেই।
যেমন অন্তরমনে মোট ছটি পর্যায় আছে মনকে বশে আনার। আমাদের মন যদি বহির্মুখী হয়, বাইরের সব কিছু শুনতে শুরু করে। প্রকৃতির নিয়মেই তা একটা সময় পর অন্তর্মুখী হবে। দ্বিতীয় পর্যায়, চোখ বন্ধ করে মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আমরা কীভাবে ভাবছি, কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি, যত রকম চিন্তা মনে উদয় হচ্ছে সব কিছুকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তৃতীয় ধাপে একটা করে চিন্তা নিয়ে এসে সেটাকে নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে তারপর ছেড়ে দেওয়া হয়। চতুর্থ পর্যায়ে অনবরত এই চিন্তা নিয়ে আসা এবং ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া অনুশীলন করতে হবে। এই পর্যায়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো চিন্তা আসবে-যাবে। পঞ্চম বা শেষ পর্যায়ে কোনও চিন্তাই থাকবে না। অর্থাৎ চিন্তাশূন্য অবস্থা প্রাপ্ত হবে। একেই বলে ‘মেডিটেটিভ স্টেজ’। পতঞ্জলি যোগসূত্রে যাকে বলা হয়েছে, যোগ চিত্তবৃত্তি নিরোধাঃ। এটাই ধ্যানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
[আরও পড়ুন: শীতের শুষ্কতায় শিশুর ত্বক রুক্ষ হতে দেবেন না, খেয়াল রাখুন ঘরোয়া উপায়ে]
আধঘণ্টা থেক ৪৫ মিনিট সুখাসনে বা সুবিধামতো অন্য কোনও ধ্যানাসনে বসতে হবে। তবে এই ধ্যান করার আগে যোগনিদ্রা বা ওম চ্যান্টিংয়ের মতো প্রক্রিয়া করা থাকলে সুবিধা হয়। আসলে শারীরিক দৃঢ়তা না থাকলে এই ধ্যানের গভীরে যাওয়া মুশকিল। তবে অসম্ভব নয়। অনেকেই ধ্যান করানোর আগে হরমোনাল অ্যাসে করানোর কথা বলে। অর্থাৎ কোন হরমোন কী পরিমাণে আছে তা দেখে নিয়ে তারপর ধ্যানের প্রেসক্রিপশন করায়। কিন্তু আমার মনে হয়, এটার তেমন প্রয়োজন নেই। আসলে যৌগিক প্রক্রিয়া আর মডার্ন মেডিসিনের প্যাথির মধ্যে ফারাক রয়েছে। ব্যক্তিবিশেষে ধ্যানের প্রক্রিয়ার রকমফের হয়। ধ্যান করে নির্দিষ্ট কোনও হরমোন নিঃসরণ বাড়ানো বা কমানো যায় না। বরং সার্বিকভাবে আমাদের অন্তক্ষরা গ্রন্থিগুলির কর্মক্ষমতায় ভারসাম্য আসে। হার্টরেট কমে, পালস রেট কমে। বিপাকীয় কাজকর্মে ভারসাম্য আসে।
কেউ যদি বুঝতে পারে যে তাঁর রাগ হচ্ছে বা অন্য কোনও অনুভূতি হচ্ছে তবে সে রাগের পরিমাণ বা সেই অনুভূতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এখানেই ধ্যানের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। সম্প্রতি গ্লোবাল ইউনিয়ন অফ সায়েন্টিস্টস ফর পিস (জিইউএসপি) হায়দরাবাদে দু’সপ্তাহ ব্যাপী এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে এই দাবি জানিয়ে বলা হয়, যুদ্ধক্লান্ত বিশ্বের শান্তি ফিরিয়ে আনতে ধ্যানের থেকে বড় অস্ত্র আর নেই। ৩০টি দেশে টিএম শেখানো হয়। ছশোটির বেশি পেপার রয়েছে। যা বৈজ্ঞানিকভাবে ধ্যানের কার্যকারিতাকেই প্রমাণ করে।
ডা. দেবাশিস ঘোষ (গবেষক, হিউম্যান বিহেভিয়র ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট): যতই আমরা মেডিটেশন নিয়ে মাতামাতি করি না কেন, ধ্যানের সাফল্যকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সাময়িক একটু ভাললাগা হয়তো হচ্ছে। কিন্তু তাতে মনের স্থায়ী পরিবর্তন আসছে না। আসলে গোড়াতেই গলদ রয়ে গিয়েছে। আমাদের একটি জিনগত মানসিক পরিকাঠামো আছে। যেটা আমরা জন্মসূত্রে আমাদের মা বা বাবার কাছ থেকে পাই। তার উপর থাকে মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে অনেক প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাব। তাতেই শুরু হয় আমাদের শরীরের ভিতর ‘সেরোটোনিন’-এর মাত্রা বৃদ্ধি বা হ্রাস। বিভিন্ন ‘জেনেটিক মেকআপ’ ও অস্বাভাবিক সেরোটোনিনের মাত্রা নিয়ে সবাইকে এক ছাদের তলায় বসিয়ে মেডিটেশন করিয়ে ভাল মানসিকতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়াটা সত্যিই দুষ্কর।
আসলে, বেশিরভাগ মানুষ মানসিক স্বাস্থের ব্যাপারে উদাসীন। বিপদে পড়লে বাঁচার জন্য আমরা কোনও মহাপুরুষ বা মনীষীর অনুগামী হই। কিন্তু তাঁদের দেখানো পথে নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারি কম। তাই আমার মনে হয়, সর্বপ্রথম প্রয়োজন শরীরে সেরোটোনিনের মাত্রা ঠিক করা। ভারসাম্য আনা। মানুষের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সেরোটিনিনের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। সঠিক মাত্রায় সেরোটিনিন থাকলে মন শান্ত ও সুখী থাকে। মানসিক স্থিতিশীলতা থাকে। মন একাগ্র থাকে। আমরা এখন সেরোটিনিনের মাত্রা রক্তপরীক্ষা করে জানতে পারি। এবং বেশি বা কম মাত্রায় থাকলে তা ওষুধ দিয়ে ঠিকও করতে পারি। তাতেই কাজ হবে ৯০ শতাংশ।
এরপর যদি কেউ কেউ আরও সচেতন হয়, মেডিটেশন শিখতে পারে। তাতে লাভ দুটি, ১) সারাজীবন ওষুধ খেতে হবে না। ২) নিজেদের আধ্যাত্মিক উত্তরণ। তবে যিনি মেডিটেশন শেখাচ্ছেন তিনি কতটা মানসিকভাবে সুস্থ বা উচ্চমানের–এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, ব্যাঙের ছাতার মতো যেভাবে যত্রতত্র মেডিটেশন সেন্টার গজিয়ে উঠছে তাতে ব্যবসায়িক মনোভাবই সবচেয়ে বেশি প্রকট হচ্ছে। তাই আগে ডাক্তারের কাছে গিয়ে সেরোটোনিনের মাত্রা মাপুন। তারপর ধ্যান করুন। তাতেই হবে অবসাদমুক্তি।
[আরও পড়ুন: হাঁটাচলার ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারে মায়োসাইটিস, সাবধান থাকুন, পরামর্শ বিশেষজ্ঞর]