তরুণকান্তি দাস, ঝাড়গ্রাম: সময় কেটে খায় উইপোকা। জল ধরো জল ভরো প্রকল্পের ইয়া বড় দিঘির জল শান্ত। শাল পিয়ালের স্নিগ্ধ ছায়ায় সময় বয়ে যায়। তবু এই গ্রাম জানে, রক্তস্নানের মানে। মাল্লেজুলা কোটেশ্বর রাওকে এই বঙ্গ চেনে না। পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড মাথা চুলকোবে অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগরের পেডডাপল্লির বাসিন্দা কোটেশ্বর নামের কারও কথা বললে। কিষান মানে কৃষক। গোদা বাংলায় চাষি। উৎপাদনমুখী জীবন। জীবিকা। আর সেই কিষানের সঙ্গে ‘জি’ যোগ হতেই তা চরমে নিয়ে গিয়েছিল ধ্বংসাত্মক আন্দোলনকে। সাতেপাঁচে না থাকা গ্রাম্য পথের বাঁকে বাঁকে একের পর এক মৃত্যুর হাতছানি। জানে এই জঙ্গল। একদা মৃত্যু উপত্যকা হয়ে ওঠা জঙ্গলমহল। যেখানে সব সময় গামছায় মুখ ঢাকা মানুষটার কাঁধের পিছন থেকে উঁকি দিত বন্দুকের নল। কারণ তিনি এবং তাঁরা বিশ্বাস করতেন, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়।
আজ সেই পার্লামেন্ট ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে এক যুগের কিছু আগেও তাঁর অঙ্গুলি হেলন ছাড়া পাতা নড়ার ক্ষমতাহীন জঙ্গলমহলের মানুষকে কোটেশ্বর রাও নয়, কিষানজির (Kisanji) নাম করলেই কেউ ফ্যালফেলিয়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। আর কেউ কপালে হাত ঠেকান, যেন রাতের বেলা সাপ শব্দটা উচ্চারণ করে ফেলেছি। সাপ নয় ওটা হবে ‘লতা’! যাঁর উত্থান হয়েছিল জঙ্গলে এবং মুখ থুবড়ে শেষ হয়েছে সেই জঙ্গলের মাটিতেই। সেই জঙ্গলের নাম বুড়িশোল। ঝাড়গ্রাম থেকে মেরে কেটে বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে এই জঙ্গলের বিপুল বিস্তার। লালমাটির গাঁ। ওই যে বাড়িটা এখান থেকে সামান্য দূরে পথের বাঁকে, সেই পথে কিষানজিদের সে কী দাপট।
শহরের রাজপথে ট্রাফিক পুলিশের ইশারায় যেমন থমকে যায় গাড়ি, লাল আলোয় থেমে যায় কনভয়ও, তেমনই কিষানজিদের ট্রাফিক তো এই পথের লাল বা সবুজ সিগন্যাল দিত। সেই অদৃশ্য সিগন্যাল পোস্ট আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এই লাল পথে, উন্নয়নের জোয়ারে। পার্লামেন্ট হল শুয়োরের খোঁয়াড় বলার লোক খুঁজতে যাওয়া এখন খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার চেয়েও কঠিন কাজ। বরং উন্নয়নের শরিক হতে ভোটের পথে প্রচারে তো বেশ কিছুদিন গ্রামীণ চৈত্র সংক্রান্তির পার্বণে যাওয়ার মতো করে হাঁটছে বুড়িশোল। এবং জঙ্গলমহলও।
[আরও পড়ুন: জল্পনায় সিলমোহর! গম্ভীরকে কোচ হওয়ার প্রস্তাব বিসিসিআইয়ের, কী জবাব তারকার?]
কিষানজির মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় হাওয়ায় উবে যাওয়া রক্ত-পথের শুরুর দিকেই তো প্রাণ হারিয়েছিলেন সিপিএম নেতা ভাগবৎ সিং। মাওবাদীরা ওড়িশা সীমান্ত থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি গ্রামে ৫২ বছরের ওই নেতাকে হত্যা করেছিল। তার পর কত রক্ত ঝরেছে শাল শিমুলের ছায়াপথে। শিক্ষক থেকে ব্যবসায়ী, নেতা, সাধারণ মানুষ। কেউ গণশত্রু, কেউ পুলিশের সোর্স। কারও বিরুদ্ধে আবার গরিব শোষণের অভিযোগ। ভোটের হপ্তাখানেক বাকি। লালগড় থেকে বেলপাহাড়ি, ঝাড়গ্রাম কোথাও আর যাই থাক কিষানজির মাওবাদীদের রক্তচক্ষু দূরের কথা, হাত জোড় করা আবেদনও নেই ভোট বয়কটের। যে বাবুইঘাস অথবা বিড়িপাতার দামবৃদ্ধির দাবি কিংবা অনুন্নয়নের ইস্যুকে হাতিয়ার করে গ্রামে গ্রামে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছিলেন সুদূর অন্ধ্র থেকে বঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে আসা মাওবাদী পলিটব্যুরোর মেম্বার ও কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের সদস্য, যাঁকে দক্ষিণ ভারতের কমরেডরা চিনত কোটা আন্না নামে, তাঁর থিওরি আজকে খাটত না।
একের পর এক আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামও উন্নয়নের শরিক। চওড়া পথ। একের পর এক সেতু। গ্রামে নলবাহিত পানীয় জলের লাইন। এসবই মাওবাদীদের সন্ত্রাস লাইনকে ভো কাট্টা করে দিত। দিয়েছেও। বুড়িশোল জঙ্গলের পাশে সরকারি প্রকল্প। সেই ইয়া বড় জলাশয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ওই গ্রামের যুবক সমীর মাহাতো অথবা পাশের সড়াঘাটার অনিরুদ্ধ মাহাতোর বিশ্বাস, ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বরই খতম হয়ে গিয়েছে মাওবাদীরা। এই বুড়িশোলের জঙ্গলেই ওইদিন ৫২ বছরের কিষানজির মৃত্যু হয়েছিল বাহিনীর সঙ্গে এনকাউন্টারে। বেশ বড় উইঢিপি আঁকড়ে থাকা একটা গাছের গোড়ায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল শরীরটা। উইপোকা কেটে খেয়েছে সময়। জনগণ মাওবাদীদের সেই রক্তাক্ত পথে আর হাঁটতে চায় না। ওহ্। দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চারণের টানে ‘জনগণ’ শব্দটা কার যেন একেবারে পেটেন্ট হয়ে উঠেছিল! সেই কোটা আন্না ওরফে কিষানজিকেই তো ভুলে গিয়েছে জনগণ। এখন জঙ্গলমহলের জনগণ জানে জনবিচ্ছিন্ন মানে।