শ্রমণ দে, গুয়াহাটি: আর মাত্র দুদিন। ১৯ এপ্রিল ঢাকে কাঠি পড়বে লোকসভা নির্বাচনের। স্বাভাবিক ভাবেই এই মুহূর্তে সর্বত্র আলোচনা ভোট নিয়েই। বিজেপির 'আব কি বা ৪০০ পার' সত্যি হবে, নাকি ইন্ডিয়া জোট দুরন্ত লড়াই করে ছিনিয়ে নেবে জয়, তা নিয়ে নানা জল্পনা শোনা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে আলাদা করে চোখ রয়েছে অসমের দিকেও। তিন দফায় ভোট হবে সেরাজ্যে। কী পরিস্থিতি? কাদের দিকে পাল্লা ভারী? কোন অঙ্ক মেনে ভোট হবে উত্তরপূর্বের রাজ্যে?
২০১৪ সালে অসমে বিজেপি পেয়েছিল ৭টি আসন। কংগ্রেস ও এআইইউডিএফ পেয়েছিল ৩টি করে আসন। একটি জিতেছিলেন নির্দল প্রার্থী। গতবার, ২০১৯ সালে বিজেপির আসনজয় বেড়ে হয় ৯। অগপ ও বিপিএফের সঙ্গে জোট বাঁধলেও ২০২০ সালে বিপিএফকে ছেড়ে ইউপিপিএলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে গেরুয়া শিবির। এবারও তারা ১৪টির মধ্যে ১১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বাকি দুটি আসন অগপ ও একটি ইউপিপিএলকে ছেড়েছে বিজেপি। শেষপর্যন্ত কী হবে? সেটা সময়ই বলবে। তবে মনে করা হচ্ছে সব মিলিয়ে বিজেপি (BJP) একাই ৯টি আসনে জিতে যেতে পারে। বাকি আসনগুলোর মধ্যে কংগ্রেস ৩টি আসন পেতে পারে। এআইইউডিএফ ১টি ও নির্দল ১টি আসনে শেষ হাসি হাসবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।
[আরও পড়ুন: এক নয়, দুই বউ বসুনিয়ার! তৃণমূল প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের দাবি বিজেপির]
কোন ম্যাজিকে বাজিমাত করতে পারে গেরুয়া শিবির? এর মধ্যে অন্যতম বাংলার 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার'-এর অনুকরণে 'অরুণোদয় প্রকল্পে' মহিলাদের মাসিক ১২০০ টাকা, বিনামূল্যে রেশন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে 'আয়ুষ্মান ভারত'-এর মতো পদক্ষেপে মহিলা ভোটারদের একটা বড় অংশের মন জিতে নিয়েছে। যা এবারের ভোটে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি আদিবাসীদের মধ্যে দানখয়রাতও বিজেপিকে অক্সিজেন দেবে। এমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
প্রসঙ্গত, ১৯ এপ্রিল, ২৬ এপ্রিল ও ৭ মে- তিন দফায় ভোট (Lok Sabha Election 2024) হবে অসমে (Assam)। প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় পাঁচটি, তৃতীয় দফায় চারটি আসনে ভোট। ৩ কোটি ১১ লক্ষ অসমবাসীর ৩৪.২ শতাংশ মুসলিম। ২ কোটি ১৯ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ১ কোটি ১২ লক্ষ পুরুষ, ১ কোটি ৭ লক্ষ মহিলা ও ৪৯১ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। কোন কোন কেন্দ্রের লড়াইয়ের দিকে নজর থাকবে? বেশি আগ্রহ ডিব্রুগড় ও জোরহাট নিয়ে। ডিব্রুগড়ে বিজেপি প্রার্থী রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। রাজ্যসভার এই সাংসদ এবার লোকসভার টিকিট পেয়েছেন। তাঁর মূল লড়াই এজেপি তথা অসম জাতীয় পরিষদের নেতা লুরিনজ্যোতি গগৈয়ের বিরুদ্ধে। এজেপিকে এই কেন্দ্র ছেড়েছে কংগ্রেস। সিএএ-বিরোধী আন্দোলন থেকেই জন্ম দলটির। এবার তারা ইন্ডিয়া জোটে শরিক হয়ে ভোটে লড়ছে। যেখানে সর্বানন্দ ছাত্র সংগঠন আসুর নেতা ছিলেন, সেখানে লুরিনজ্যোতিরও কিন্তু উত্থান আসু নেতা হিসেবেই। ২০১৯ ও ২০২০ সালে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের মুখ এই নেতার সঙ্গে সর্বানন্দ সোনওয়ালের লড়াই কী দাঁড়াবে সেদিকে চোখ থাকবে সকলের। তবে এখানে কিন্তু ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু যত সময় এগিয়েছে তত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আপ প্রার্থী মনোজ ধনোয়ারের সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। ডিগবয়ের আটবারের কংগ্রেস বিধায়ক রামেশ্বর ধানোয়ারের ছেলে লড়াই থেকে হারিয়ে গিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
[আরও পড়ুন: অশান্তির আশঙ্কা, অনুমতি দিয়েও রামনবমী পালনের নির্দেশ প্রত্যাহার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে]
এদিকে জোরহাটের হেভিওয়েট প্রার্থী গৌরব গগৈ। এই কংগ্রেস নেতা অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের পুত্র। তিনি কলিয়াবরের সাংসদ। কিন্তু এবার ওই লোকসভা কেন্দ্রের পুনর্বিন্যাস হয়ে তা কাজিরাঙা কেন্দ্র হয়ে গিয়েছে। নতুন বিন্যাসে মুসলিম ভোট বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ফলে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের সমস্যা তৈরি হয়েছে। আর সেই কারণেই গৌরব এবার দাঁড়াচ্ছেন জোরহাট থেকে বলে ধারণা। তবে বিদায়ী সাংসদ তথা বিজেপি প্রার্থী তপন গগৈয়ের সঙ্গে লড়াই যে খুব আসান হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
নজর থাকবে কোকড়াঝাড়ের নির্দল প্রার্থী হীরা সরনিয়ার দিকেও। তাঁর জেতার সম্ভাবনা প্রচুর। স্থানীয়দের মত, আলফা জঙ্গি হীরা এখানে ভূমিপুত্র হওয়ার ফায়দা তুলবেন। অসমের জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলেও ভোটব্যাঙ্কে তিনি ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন। মনে করা হচ্ছে, সেই কৌশল কাজে আসতে চলেছে। অন্যদিকে ধুবড়ি আসনে ক্ষমতা ধরে রাখবেন এআইইউডিএফ দলের প্রধান বদরুদ্দিন আজমল। শিলচরে বিজেপি প্রার্থী পরিমল শুক্লবৈদ্যরই পাল্লা ভারী। পাশাপাশি নগাঁও, কাজিরাঙাতে হিন্দু বাঙালিদের ভোট যেতে পারে বিজেপির দিকেই। আগে যা পেয়ে এসেছে কংগ্রেস।
সব মিলিয়ে অসমে ভোটের ছবিটা ঠিক কেমন? কী মনে করছেন অসমবাসী? কথা হচ্ছিল কাজিরাঙার চা ব্যবসায়ী বেদব্রত দেবের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ''এবারে অসমে বিজেপি যেভাবে রাজনীতি করছে, তা আমরা আগে দেখিনি। মন্দির থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানীয় কমিটিতেও ঢুকে পড়ছে বিজেপির লোকজন। কংগ্রেসের জমানায় এমনটা ছিল না। এসব নিয়ে রাজনীতি হত না। এতে ব্যবসায়ীরা কিছুটা ক্ষুণ্ণ। তাছাড়া কাজিরাঙায় কংগ্রেসের একটা ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে। ফলে লড়াইটা জোরদার হবে। এবং কিছুটা হলেও কাজিরাঙায় কংগ্রেস প্রার্থী রোজলিনা তির্কির পাল্লা ভারী থাকবে।'' বলে রাখা ভালো, কাজিরাঙা লোকসভা কেন্দ্রে চা জনজাতির ভোট একটা ফ্যাক্টর। তাই কংগ্রেস ও বিজেপি, দুইয়ের প্রার্থীই আদিবাসী। তাই বিজেপি প্রার্থী কামাখ্যাপ্রসাদ তাসাও লড়াইয়ে থাকবেন।
সিএএ যে একটা ফ্যাক্টর হবে তা নিয়ে একমত কমবেশি সকলেই। সারা অসম বাঙালি যুব-ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি দীপক দে বলছেন, ''সিএএ-তে অসমের বাঙালিদের খুব বেশি লাভ হয়নি। যে হিন্দু বাঙালিদের ডি-ভোটার তকমা দেওয়া হয়েছে, যারা ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক, তারা কি মুক্তি পাবে? নতুন আইনে এগুলো স্পষ্ট নয়। বরং এতে অসমিয়া ভাষীদের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অসমে বাংলাদেশি বাঙালি নেই। মাত্র একজন নাগরিকত্ব আইনে আবেদন জানিয়েছেন। তবে অসমে বিরোধী দলগুলো দিশেহারা। হিন্দু বাঙালি ভোটারদের কাছে বিকল্প নেই। তাই তাঁদের ভোট বিজেপিতেই যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।''
অন্যদিকে গোলাঘাট জেলার শিঙিমারি গ্রামের বাসিন্দা প্রাণকৃষ্ণ দাসের কথায়, ''সিএএ আসায় আমরা আশ্বস্ত।'' বছর পঁয়তাল্লিশের এই ব্যক্তির দাবি, ''আমার বাবা প্রহ্লাদ দাসকে বিদেশি তকমা দিয়ে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। গরু বিক্রি করে মামলা চালিয়েছেন তিনি। সেসব দিন তো ভুলিনি। আমি ভোট দিই, আমার ছেলেমেয়েরাও ভোটার। তবুও মাঝে মাঝে 'বাংলাদেশি' খোঁটা শুনতে হয়।''
এদিকে স্থানীয় সাংবাদিক সরফরাজ খান বলছেন, ''হিমন্ত বার বার বলছেন ১২টা আসন পাবেন। কংগ্রেস (Congress) ধুয়েমুছে সাফ। কিন্তু আসল ছবিটা তা নয়। যেমন নগাঁও আসনে প্রদ্যুৎ বরদলুই ভালো লড়াই দেবেন। জোরহাটে গৌরব গগৈ লড়াইয়ে রয়েছেন পুরোদমে। তবে ২ শতাংশ ভোট সুইং হলে ছবি পালটে যাবে। অসম গণ পরিষদ বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়লেও জাতীয়তাবাদের সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোট টানার পরিস্থিতি নেই। তবে বিজেপির জন্য যেটা স্বস্তির, তা হল সিএএ (CAA) নিয়ে যে মাত্রায় বিক্ষোভ হবে ভাবা গিয়েছিল তা হয়নি।''
সব মিলিয়ে শেষ হাসি হাসবে কে, তা সময়ই বলবে। তবে মনে করা হচ্ছে, বিজেপি (BJP) একাই ৯টি আসনে জিতে যেতে পারে। বাকি আসনগুলোর মধ্যে কংগ্রেস ৩টি আসন পেতে পারে। এআইইউডিএফ ১টি ও নির্দল ১টি আসনে শেষ হাসি হাসবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।