সরোজ দরবার: মন্টোকে নিয়ে বাংলায় একটি সিনেমা তৈরি হতেই পারত। ‘দোজখনামা’র মতো উপন্যাস বাংলাতে লেখা হয়েছে বলেই তা সম্ভব হতে পারত। রবিশংকর বল মহাশয় তো মন্টোকে বহুদিন আগেই চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ঋত্বিক চক্রবর্তীকে হয়তো বেশ মানিয়েও যেত। পরিচালনা করার প্রতিভার অভাব তো নিশ্চয়ই নেই। আর প্রোডিউসর! সেও নয় কপাল ঠুকে জুটে যেত। তবু বাংলায় মন্টো হল না। সম্ভবত সিরিয়ালের কন্টেন্ট কত খারাপ তাই নিয়ে বৌদ্ধিক বাঙালির আলোচনার সময়ে টানাটানি পড়ে যেত বলেই বাংলায় কেউ মন্টোকে নিয়ে চলচ্চিত্রের কথা ভাবলেন না। এমনকী ‘দোজখনামা’ হাতে থাকার পরও নয়।
আক্ষেপ দিয়ে লেখা শুরু করার মতো হতাশা আর নেই। কিন্তু ঘটনা এই যে, মন্টো এমন এক তীব্র অস্বস্তি যাকে আমরা সচেতনভাবে দূরেই সরিয়ে রাখি। রাখতে পছন্দ করি। যেমন কিছু খিস্তি আর ফ্যাতাড়ুর সংলাপের ছাঁচ তৈরি করে আড়াল করে ফেলি নবারুণ ভট্টাচার্যকে। তা সত্ত্বেও মন্টোর সেই অস্বস্তি, সেই সুস্থির হতে না দেওয়া, সেই প্রতি মুহূর্তের ভাঙচুরকে তীব্র, সফল ও সার্থকভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন নন্দিতা দাশ।
[অস্কারে যাচ্ছে ইরফানের প্রথম বাংলা ছবি ‘ডুব’]
অন্ধকার শীতল সিনেমাঘরে যখন ‘ঠান্ডা গোস্ত’-এ সিনেম্যাটিক মূহূর্তকে প্রায় শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিচ্ছেন দিব্যা দত্ত ও রণবীর শোরে, তখন যেন অদূরে রাখা পপকর্নের টাবকে ছোঁয়াও পাপ বলে মনে হয়। অথবা এটাই সেই পবিত্র মুহূর্ত, যখন আয়নার সামনে দাঁড়াতে অস্বীকার করে না মানুষ। মন্টো আদালতে দাঁড়িয়ে সওয়ালে যা বলেছিলেন, কেউ খারাপ দেখতে বলে আয়নায় তাকাতে অস্বীকার করলে লেখকের কিছু করার থাকে না। এই নগ্নতার মুখোমুখি হওয়ার নামই মন্টো। আমাদের আত্মপ্রবঞ্চনা ধরা পড়ে যাওয়ার নামই মন্টো। না তাঁর লেখায়, না তাঁর জীবনে- কোথাও তিনি একমুহূর্তের সুস্থিতি দেন না। সারাক্ষণ আমাদের ফালাফালা করেন, আমাদের বোধ আর বিবেকের কাছে আমাদের হিপোক্র্যাসি আর ফ্যালাসিগুলোর বোতাম খুলে দিয়ে গুঁড়োগুঁড়ো করে দেন আমাদের জীবনের শান্তিবিলাস। এই যে মন্টো, এই অস্থিরতা এই বিব্রত করা স্বভাবের মন্টোকে এই শীতল সময়ে ফিরিয়ে এনেছেন নন্দিতা। এবং বিস্ময়ে খেয়াল করি, যে মন্টো ‘তোবা টেক সিং’ তৈরি করেন, যে মন্টোর কোনও দেশ থাকতে পারে না, স্ট্রাকচার্ড কোনও ধারণায় যাঁকে ফেলা অনুচিতও অসম্ভব, তাঁর বায়োপিক শুরু হওয়ার আগেই রাষ্ট্রের জাঁকালো ধারণা বলে- অনুগ্রহ করে জাতীয় সঙ্গীত শুরু হওয়ার আগে দাঁড়ান। হায় মন্টো! হায় দেশ! হায় মানুষ! এখনও ‘চুতিয়া’ বললে ইংরেজি সাব টাইটেলে f*** লিখতে হয়। হায়রে শিল্পমনস্কতা! আসলে নন্দিতা মন্টোকে এমন একটা সময়ে হাজির করেছেন, যখন ধর্ম উন্মাদনা চরমে, বাক স্বাধীনতা আজও যে তিমিরে সে তিমিরেই আর সর্বোপরি কনজ্যুমারিজমের দাপট আমাদের শিরায় ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমরা সবকিছুই মেনে নিতে শিখেছি। কর্পোরেট শ্লেভারি আমাদের শিরদাঁড়া নুইয়ে দিয়েছে। আর বিশ্বায়নের নামে ছদ্ম কলোনিয়ালিজম আমাদের বোধে গড়ছে উপনিবেশ। আর তার ফাঁক দিয়েই মাথাচাড়া দিচ্ছে মৌলবাদ। সমূহ আগুনকে ডাস্টবিনে চাপা দিয়ে আমরা এসি চালিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের কন্ট্যাক্ট লেন্সে কমপিউটরের নীল আলো ছাড়া আর কোনও মানুষের চোখের আলো ছায়া ফেলে না। সমস্ত উন্মাদনার পক্ষ ও বিপক্ষ নিতে নিতে আমরা উসকে দিচ্ছি সর্বনাশকেই। এবং তা যে দিচ্ছি, সেই আগুন যে আমাকেও পুড়িয়ে ফেলতে পারে সেই ভবিষ্যৎটুকুও আমাদের অজানা নয়। ফলে বিপর্যয়ে এখন আর আমাদের চোখের পাতা কাঁপে না। সমস্ত ভাঙন মেনে নেওয়া এই ক্ষণভঙ্গুর মন নিয়ে মান্টোর চাবুক সহ্য করাই অসহনীয়। আসলে মন্টো তো সেইরকম যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ যার উপর আমাদের নান্দনিক ফেসবুকিয় জীবন ‘কভার’ টেনে দেয় অবধারিতভাবেই।
নন্দিতা কোথাও কিছু দাগিয়ে দেননি। অপূর্ব সংযম তাঁর। যেমনটা ছিল তাঁর ফিরাক-এও। তাঁর অভিনেতারাও কোথাও এতটুকু উচ্চকিত নন। যেখানে যাঁর থেকে যতটুকু দরকার, নন্দিতা ছবিতে ততটুকুই নিয়েছেন। পরেশ রাওয়াল থেকে তিলোত্তমা সোম বা রসিকা দুগল কিংবা রাজ্যশ্রী পাণ্ডের থেকে তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় সেরাটুকু ছেঁকে নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে পরিচালকের দক্ষতা বোঝা যায় যখন নামী অভিনেতারাও এমন অনায়াসে কেবল ও কেবলমাত্র চরিত্র হয়ে ওঠেন। এমনকী তাঁর নায়ক নওয়াজউদ্দিনকেও তিনি এতদিনের সমস্ত ম্যানারিজম থেকে বের করে এনেছেন। অতীতের সমস্ত কাজ মাথায় রেখেও বলতে হয় এ ছবি অভিনেতা নওয়াজের নবজন্মই বটে। আশ্চর্য ‘হিপতাল্লা’ আয়ত্ত করেছেন তিনি। আর অপূর্ব সংযমের অনুশীলন নন্দিতার প্রতিবাদে। অনুমান করা যায় এই সময়ে দাঁড়িয়ে যিনি মন্টোর বায়োপিকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন তিনি এই সর্বগ্রাসী, একনায়কতন্ত্রী সময়কে তাঁর বিবেকের পুরোহিত হতে দেননি। যে চাবুক মারার ছিল। যে ফালাফালা প্রার্থিত ছিল, যে প্রতিবাদ করার দরকার ছিল তা তিনি করেছেন মন্টো নামক আয়নাখানা মুখের উপর তুলে ধরেই। বাকিটা সুধী দর্শকই বুঝবেন। একদা মন্টোও তাই-ই করেছিলেন। নন্দিতা মন্টোর বায়োপিক শুধু বানাননি, একজন শিল্পী হয়ে আর একজন জাতশিল্পীর দর্শন ধরে হেঁটে গিয়েছেন সময়ের পথে।
[শাহরুখ আমায় অভিনয় শিখতে বলেছিল: কাজল]
এই সময়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে ওঠা মেদ আর ক্লেদ ঝরাতে জরুরি ছিল মন্টোকে, নন্দিতা রাস্তা চিনতে ভুল করেননি। আসলে নিমপাতা যত তেতোই হোক, রক্ত সেই-ই তো পরিষ্কার করে। মন্টোর চাবুক তাই যত অসহ্যই হোক, এই উন্মাদ বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হবে। মন্টো দাঁড়িয়েছিলেন। সেই একরকম ঘুণপোকার মুখে আত্মাকে ফেলে দেওয়ার বদলে নন্দিতাও তার সংযমী প্রতিবাদ চিত্রায়িত করে রাখলেন। বস্তুত একজন শিল্পী এর থেকে বেশি আর কী-ইবা করতে পারেন! আত্মম্ভরী, একনায়কতন্ত্রী সমাজে তিনি ছড়িয়ে দিতে পারেন ইশতেহার, ইন্ধন দিতে পারেন সমস্ত রুখে দাঁড়ানোয়। ‘মন্টো’ আসলে প্রকাশ্যে বিলি করা নন্দিতার সেই সান্ধ্যভাষায় লেখা লিফলেট।
The post ‘মন্টো’র চাবুক অসহ্য বলেই সার্থক নন্দিতার প্রতিবাদ appeared first on Sangbad Pratidin.