ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: ‘বন্যেরা বনে সুন্দর। শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’
বঙ্কিম-অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই বহুল প্রচলিত উক্তি সামান্য পালটে লকডাউনের পৃথিবীতে আজ অনায়াসেই বলা যায়- ‘বন্যেরা রাজপথে সুন্দর। যখন মানুষ গৃহকোণে।’
বলা যায়, বাংলার আকাশ-বাতাস জুড়ে বেজে ওঠা আনন্দের কলধ্বনিতে। টানা ২৭ দিন ধরে স্ব-আরোপিত লকডাউনে ঘরে ঢুকে যখন বেঁচে থাকার চেষ্টায় মরিয়া রাজ্যবাসী, তখন পাখির কূজনে মুখর বঙ্গভূমের প্রকৃতি। খাস কলকাতা থেকে সুন্দরবনের গহীন বন-গোটা বাংলা জুড়ে বন্যপ্রাণ মেতেছে যেন উচ্ছ্বাসে!
যেমন জলপাইগুড়ি। উত্তরবঙ্গের এই তোর্ষা নদীর কূলে জেলা সদরের আকাশ জুড়ে দেখা মিলছে প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসা ‘হোয়াইট র্যাম্প ভালচার’-এর। অবশ্য শুধু জলপাইগুড়ি কেন? পার্শ্ববর্তী নেপাল, অসমের আকাশেও ডানা মেলে পাক খাচ্ছে এই প্রজাতির শকুনের পাল। খাস কলকাতার ছবিটাও যে একইরকম! কংক্রিটের এই শহরের ইতি-উতি গাছের ফাঁকে, ঝোপের ছায়ায় দেখা মিলছে ময়নার। রাজভবনের গাছে ঢাকা বিস্তৃত বাগানে দেখা মিলেছে মৌটুসি, বসন্তবউরি, কুবো পাখিদের। যা দেখে রীতিমতো উৎফুল্ল বনদপ্তর। খুশির রোদ পক্ষীবিশেষজ্ঞদের মুখে। ওয়েস্ট বেঙ্গল বায়োডাইভারসিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান ডঃ অশোককান্তি সান্যালের কথায়, “রাস্তায় ঘাটে, মুক্তাঙ্গনে লকডাউনের জেরে মানুষ উপস্থিতি এখন অনেক কম। তাই পশু-পাখি এখন নিজেদের অনেক বেশি নিরাপদ মনে করছে। স্বচ্ছন্দে ঘুরছে যেখানে প্রাণ চায়।” তাঁর কথায়, “দীর্ঘদিন এমন নিরুপদ্রব সময় পায়নি বন্যপ্রাণ। তাই পাখিরাও প্রজননের জন্য বেছে নিয়েছে এই সময়টাকেই।” রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আমাদের সুন্দরবনের বিট অফিসগুলির কাছে ইদানিং প্রায়শই বাঘ চলে আসছে। ট্র্যাপ ক্যামেরায় এত বেশি বাঘের ছবি আগে দেখা যায়নি।” বন্যপ্রাণীর এমন অবাধ বিচরণ আগে হয়নি।”
[আরও পড়ুন : করোনা দমনে বাঙালি গবেষকের কামাল, সংক্রমণ এড়াবে এই বিশেষ মাস্ক]
লকডাউনের অখণ্ড এই অবসরে রাজভবনের মধ্যেই দেখা মিলছে ‘রেড থ্রোটেট ফ্লাই ক্যাচার’। গ্রামবাংলায় চলতি নাম যার ‘চুটকি’। পক্ষীবিশেষজ্ঞ অপূর্ব চক্রবর্তীর কথায়, “গ্রামের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম! দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অনেক জায়গায় গাছের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে মৌটুসি পাখি। দেখা যাচ্ছে বেনেবউ, বসন্তবাউরি, কুবো পাখি। একসঙ্গে এত পাখির কলরব আগে শোনা যায়নি শহর কলকাতার বুকে।” অপূর্ববাবুর কথায়, ‘রেড থ্রেডেড ফ্লাই ক্যাচার’ বা চুটকি পাখির দেখা মেলে সুদূর রাশিয়ার তাইগা অঞ্চলে। শীতের সময়ে এরা চলে আসে কলকাতায়। লকডাউনের সৌজনে্য ভরা বৈশাখেও এই পাখির দেখা মিলেছে রাজভবন থেকে দক্ষিণ শহরতলির নরেন্দ্রপুরের ঝোপ-জঙ্গলে। আবার খাস কলকাতার বুকেই পক্ষীবিশেষজ্ঞদের নজরে এসেছে মোহনচূড়া। রাজভবন থেকে ভেসে আসছে কার্যত বিরল হতে বসা সোনাবউ, বেনেবউ, দামা পাখির। “অন্তত তিরিশ বছর আগে শহরতলির হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় দেখা যেত এই দামা পাখি। মাটিতে বসে ঘুরে ঘুরে শিস দিয়ে গান গাইত। অনেক বছর পর আবার শহরে দেখা মিলেছে তার।” বলছেন অপূর্ববাবু।
[আরও পড়ুন : এখানেও ‘দূরত্ব’ বজায়ের নিয়ম! নির্দিষ্ট ব্যবধানে এক সরলরেখায় শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতি]
অতীতে রাজভবন ও সংলগ্ন গড়ের মাঠ চত্বরের পাখিজগৎ নিয়ে প্রায় দশবছর ধরে যৌথ উদ্যোগে সমীক্ষা করেছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল বায়ো ডাইভারসিটি বোর্ড ও রাজভবন। সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল রাজভবনের বিস্তৃত বাগনের গাছগাছালির আশ্রয়ে অন্তত আড়াইশো প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের পাখি রয়েছে। সমীক্ষাটি যিনি করেছিলেন, সেই বঙ্গবাসী কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা সুচিত্রা ঘোষ জানাচ্ছেন, “কলকাতা বা রাজভবনের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রচুর গাছপালা রয়েছে। শীতের সময় যেমন প্রচুর সংখ্যায় পরিযায়ী পাখি আসে, তেমনই সারা বছর বাসা বেঁধে থাকে বাংলার নিজস্ব পক্ষীকুলও। এতদিন তারা গোপন আস্তানায় ছিল। লকডাউনের সৌজন্যে তারা অাবার ফিরে আসছে।
The post লকডাউনে প্রকৃতির অন্যরূপ, কলকাতায় এখন পাখির ‘হোক কলরব’ appeared first on Sangbad Pratidin.