সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: পূর্ব ইউরোপে দুই রাষ্ট্রের সংঘাতের আঁচ হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের পশ্চিমবঙ্গে। বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেনের (Ukraine) মাটিতে রাশিয়ার প্রথম গোলাটি আছড়ে পড়তেই দুশ্চিন্তার অতলে ডুবে গিয়েছে এ রাজ্যের সাগর থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন পরিবার, যাদের কেউ না কেউ ইউক্রেনে রয়েছেন, প্রায় সবাই মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উড়ানও বন্ধ। এমতাবস্থায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে আটকে পড়া ছেলেমেয়ের কুশল-চিন্তায় বাড়ির লোকের ঘুম ছুটেছে। তাঁদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু অভিভাবক স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারস্থ।
উত্তর ২৪ পরগনার (North 24 Parganas) হাবড়ার জুলফিকার বিশ্বাস। কুমড়া গ্রামপঞ্চায়েতের কাশীপুর দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা জুলফিকারের মেয়ে নিশা বিশ্বাস গত ডিসেম্বরের ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছেন। যুদ্ধ বাধায় গোটা পরিবার মেয়েকে নিয়ে ঘোর উদ্বেগে। ইতিমধ্যে তাঁরা স্থানীয় পঞ্চায়েতে আবেদন জানিয়েছেন, নিশাকে যেন বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করে সরকার। এদিন জুলফিকার বলেন, “আজ দুপুর বারোটার পর মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হল। বলল, খুব আতঙ্কে রয়েছে। খাবারদাবারে টান পড়েছে, হস্টেলে পর্যাপ্ত খাবার মজুত নেই। খুবই চিন্তায় আছি।” আপাতত বিশ্বাসবাড়ির একটাই প্রার্থনা, মেয়ে সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে আসুক। একই অবস্থা উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার সাধুখাঁবাড়ির। বেড়গুম ১ নম্বর গ্রামপঞ্চায়েতের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা দেবাশিস সাধুখাঁর মেয়ে স্বাগতাও তিন বছর আগে কিয়েভে গিয়েছেন ডাক্তারি পড়তে। সেখানকার মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী তিনি। ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে বাড়ির লোক উদ্বেগে ছিলেন, এদিন সকালে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ লাগার খবরে ওঁদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। উড়ানও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মেয়েকে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনার আরজি নিয়ে তাঁরা জেলাশাসকের দপ্তরে যোগাযোগ করেছেন।
[আরও পড়ুন: হাতে নয়, ভাতে মারার চেষ্টা, রাশিয়ার উপর একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা চাপালেন বাইডেন]
একই জেলায় একই রকম উদ্বেগের প্রহর গুনছে আর এক পরিবার। বসিরহাট পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অর্পণ মণ্ডল তিনবছর আগে ডাক্তারি পড়তে ইউক্রেনে গিয়েছেন, তিনি ডিনিপ্র পেট্রোভ্যাদক্স মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আগামিকাল তাঁর দেশে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু উড়ান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কবে ফিরতে পারবেন ঠিক নেই। বাড়ির লোক চিন্তায় অধীর। অর্পণ বৃহস্পতিবার ফোন করে বাড়িতে নিজের কুশল সংবাদ দিলেও মা-বাবার মন মানছে না। বসিরহাট হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক রামপদ মণ্ডল ও চন্দনা মণ্ডলের একমাত্র সন্তান অর্পণের সঙ্গে এদিন যোগাযোগ করে হলে তিনি বলেন, “ভোর সাড়ে চারটেয় বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙল। হস্টেল থেকে বেরিয়ে জানতে পারলাম, রাশিয়া অ্যাটাক করেছে। সুপার মার্কেট ভিড়ে ভিড়াক্কার, সবাই খাবার স্টক করতে ব্যস্ত। এটিএম বন্ধ। যে ইউক্রেনকে ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয় সেখানেই রুটি পাওয়া যাচ্ছে না।” রামপদবাবুর কথায়, “ভীষণ চিন্তায় রয়েছি। আমার মতো অনেক মা-বাবার তরফে ভারত সরকারের কাছে আরজি, সন্তানদের দ্রুত বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা হোক।”
ছেলেকে ফেরাতে সরকারের কাছে কাতর আবেদন জানাচ্ছেন উপকূলবর্তী পূর্ব মেদিনীপুরের এক পরিবারও। নন্দকুমার থানার ভূঞ্জাখালি গ্রামের অর্ণব মান্না ডাক্তারি পড়তে গিয়ে ইউক্রেনে আটকে পড়েছেন। রুশ হামলার খবর পেয়ে বাড়ির লোকের উদ্বেগের অন্ত নেই। পাশাপাশি ইউক্রেন সংঘাতের জেরে পাহাড়ঘেঁষা উত্তরবঙ্গে কোনও পরিবারে স্বস্তি, কোনও পরিবারে চিন্তার চোরাস্রোত। রাশিয়া যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করতেই চার্টার্ড ফ্লাইটে ৫০ জন ভারতীয় পড়ুয়া দিল্লি ফিরে এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে শিলিগুড়ির তিন জন–বিতান বসু, অনন্যা মৈত্র ও সুকৃতি দেব। সবাই ডাক্তারি পড়ুয়া। যদিও বিমান না মেলায় বিতান ছাড়া এখনও কেউ শিলিগুড়িতে পা দিতে পারেননি।
[আরও পড়ুন: রুশ চপার থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমা, ইউক্রেনে নিহত তিনশোরও বেশি]
বৃহস্পতিবার বিকেলে বিতান বাড়ি এসেছেন। মা বন্যা বসু বলেন, “বেশ কিছু দিন ধরে ফেরার চেষ্টা করছিল, কিন্তু প্লেনের টিকিট পাচ্ছিল না। শেষে ওদের কলেজ থেকে চার্টার্ড প্লেনের ব্যবস্থা করে দেয়।” বিতানের প্রতিক্রিয়া, “আতঙ্কে ছিলাম, তবে ঘাবড়ে যাইনি। জানতাম, যে করে হোক দেশে ফিরতেই হবে। সপ্তাহখানেক আগে ভারতীয় দূতাবাসই আমাদের ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছিল। আমার অনেক বন্ধু ওখানে আটকে রয়েছে। আশা করি, ওরা নিরাপদে থাকবে।” জানা গিয়েছে, অনন্যা ও সুকৃতি আজ শুক্রবার শিলিগুড়ি ফিরবেন। কিন্তু এই স্বস্তির মধ্যেও রয়েছে বিষাদের ছায়া। কারণ, ইউক্রেনে আটকে রয়েছে শিলিগুড়ির আর এক ছাত্র প্রীতম মালাকার। চিকিৎসক পীযূষকান্তি মালাকারের ছেলে প্রীতমও ডাক্তারি পড়তে সে দেশে গিয়েছেন। পীযূষবাবু বলেন, “খুব চিন্তায় আছি। শেষবার যখন কথা হল, জানাল পরিস্থিতি খুব খারাপ। তারপর আজ তো যুদ্ধ লেগেই গেল।” ঘরের ছেলে সুস্থভাবে ঘরে ফিরুক। পরিজন থেকে পড়শি সবার এই একটাই প্রার্থনা।