দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ শুটিংয়ের (মিক্সড ইভেন্টে) ১০ মিটার এয়ার রাইফেল শুটিংয়ে স্বর্ণপদক জিতে অনন্য নজির গড়েন হুগলির বৈদ্যবাটির মেহুলি ঘোষ (Mehuli Ghosh)। তবে মেহুলির এই সাফল্যের শিখরে পৌঁছনোর পথটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। কিন্তু মা ও দিদিমার অনুপ্রেরণায় শেষ পর্যন্ত রাইফেল শুটিংয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন মেহুলি। অলিম্পিকে অভিনব বিন্দ্রাকে দেখে রাইফেল শুটিং শেখার জন্য মা-বাবার কাছে রীতিমতো বায়না শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত মেয়ের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে মেহুলিকে শুটিংয়ের জগতে নিয়ে যান বাবা-মা। বুধবার সোনা জেতেন মেহুলি। আজ, বৃহস্পতিবার মহিলাদের দলগত ইভেন্টে রুপো জেতেন তিনি।
বাবা নিমাই ঘোষ একটি আধা সরকারি সংস্থায় কাজ করেন। খুব সামান্যই রোজগার তাঁর। নিমাইবাবু মেয়েকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর আর্থিক সামর্থ্য নেই। কিন্তু তারপরও মেয়ে মাঝে মধ্যেই কান্নাকাটি করত। শেষ পর্যন্ত দিদিমা মঞ্জু পাল তাঁকে বলেন মেয়েকে রাইফেল শুটিংয়ে ভরতি করে দেওয়ার জন্য। এটাও বলেন, তিনি যতটা খরচ পারবেন দেবেন। প্রথমে শ্রীরামপুর রাইফেল শুটিং ক্লাবের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পরে কলকাতার নিউটাউনে জয়দীপ কর্মকারের অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে মেহুলি। নিমাইবাবু জানান মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য মা মিতালি ঘোষ নিজের সোনা বন্ধক দিয়ে রাইফেল কিনে দেন। সেই সময় শেওড়াফুলি ফাঁড়ির পুলিশ কর্তা সুব্রত দাস পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
[আরও পড়ুন: বানচাল মোদিকে হত্যার ছক! বিহার থেকে ধৃত দুই সন্ত্রাসবাদী]
নিউটাউনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় নিমাই বাবু সকালে অফিসে যাওয়ার সময় নিয়মিত স্ত্রী ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতেন। মা ও মেয়ে বালিতে নেমে বাসে করে নিউটাউন যেতেন। প্রায় তিন বছর ধরে মেহুলির মা অ্যাকাডেমির বাইরে চায়ের দোকানে বসে থাকতেন। রাতে নিমাইবাবু অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বৈদ্যবাটির বাড়িতে ফিরতেন। মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে অ্যাকাডেমির বাইরে অপেক্ষা করতেন মেহুলির মা।
পরবর্তীকালে নিউটাউনে মা বাবা মেয়ে থাকা শুরু করলেও ২০২১-এ মেহুলি হায়দরাবাদে গগন নারাংয়ের শুটিং অ্যাকাডেমিতে বিবস্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের কোচিংয়ে অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলে তারা বৈদ্যবাটির বাড়িতে চলে আসেন। এই বিবস্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশিক্ষণে অনেকটাই উন্নতি করে মেহুলি। আজ মেয়ের এই সাফল্যে মা ও বাবা দুজনেই রীতিমতো খুশি। মঙ্গলবার ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের ব্যক্তিগত ইভেন্টে অল্পের জন্য ফাইনালে কোয়ালিফাই না করতে পারার জন্য মেহুলি তার মাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘একটুর জন্য ফাইনালে উঠতে পারলাম না।’’
মিতালি দেবী তখন মেয়েকে আগে কী হয়েছে, সে’সব ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দেনন। একইসঙ্গে পরের ইভেন্টের জন্য মনঃসংযোগ করতে বলেন। মায়ের এই কথায় মেহুলি অনেকটাই অনুপ্রাণিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত বুধবার তুষার মানকে সঙ্গে নিয়ে মিক্স ইভেন্টে স্বর্ণপদক জিতে নজির গড়েন মেহুলি। যা নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসছে বাংলা। তেরো বছর বয়সে রাইফেল শুটিং -এর হাতেখড়ি মেহুলির। ২০১৪ য় বেলগাছিয়ায় স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে রুপোর পদক জিতে প্রি ন্যাশনাল শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য মনোনীত হন মেহুলি। আমেদাবাদে প্রি ন্যাশনাল রাইফেল শুটিংয়ে অংশগ্রহণ করে ব্রোঞ্জ পদক জিতে ন্যাশনালের জন্য মনোনীত হন। তবে ন্যাশনালে সেভাবেই দাগ কাটতে না পারলেও হাল ছাড়েননি মেহুলি।
২০১৭য় ন্যাশনাল ইউথ জুনিয়ার এন্ড সিনিয়ার চ্যাম্পিয়নশিপে একসঙ্গে ন’টি মেডেল জিতে চ্যাম্পিয়ন হন মেহুলি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তবে মেহুলির পরিবারের আক্ষেপ একটাই ২০১৮-য় অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ গেমস যোগ দেওয়ার জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারেননি মেহুলি। ২০২২-এ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন এই শুটার।