কৃষ্ণকুমার দাস: ঠাকুরদার জমি ছিল, উনি চাকরি পেয়েছেন। তার পর বাবা, সেখান থেকে আমি। তিনপুরুষ ধরে মাটির নিচে নেমে কয়লা তুলছি। মাস গেলে লাখ টাকা বেতন পাচ্ছি, সাথে ‘দিদির সরকার’ থেকেও অনেক রকম সাহায্য-টাকা তো পাচ্ছি আমরা। নিঘা কয়লাখনির ২৩৪ ফুট গর্ভীর থেকে উঠে আসা ট্রলির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলি বলছিলেন খনি শ্রমিক অসিত রুইদাস।
অসিতের বাড়ি একটু দূরে পাণ্ডবেশ্বরের হরিপুর গ্রামে। খনির জন্যই সাত পুরুষের ভিটে থেকে একটু সরে আসতে হয়েছে। অসিতের ঠাকুরদা কৃষ্ণ রুইদাস নিঘা খনি চালুর বছর কয়েকের মধ্যে জমি দিয়ে চাকরি পান। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর বাবা কেবল রুইদাস, পরে ছেলে খনি অঞ্চলের ‘ট্র্যাডিশন’ মেনে ১৯২৭ সালে শুরু হওয়া এই খনিতে চাকরি পেয়েছেন। অসিতের মতো প্রায় ৪৭ হাজার স্থায়ী খনি শ্রমিক-কর্মচারি রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, পাণ্ডবেশ্বর, বারাবনি, কুলটির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূগর্ভস্থ ঐশ্বর্যে পূর্ণ এলাকা জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ইসিএল সংস্থায় কর্মরত। খোলামুখ ও ভূগর্ভস্থ খনি মিলিয়ে ৭৮টি কয়লা উত্তোলন কেন্দ্র ঘিরে দৈনিক কোটি কোটি টাকার বৈধ ও অবৈধ দুধরনের লেনদেন হয়। পরোক্ষে আরও ৫০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এই খনিনির্ভর। কয়লার এই নেটওয়ার্কে ঝাড়খণ্ডি ও বাঙালি মিলিয়ে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যাও প্রায় ৪৮ হাজার। আগে এই অস্থায়ীরাই ধাপে ধাপে নানা চক্রে স্থায়ী হতেন। কিন্তু গত ১০ বছরে কেন্দ্র বেসরকারীকরণের পথে ভূগর্ভস্থ খনিতে একের পর এক বিদেশি মেশিন বসিয়েছে। একটা মেশিন বসলে ১২০০ থেকে দেড় হাজার শ্রমিকের চাকরির পথ বন্ধ হচ্ছে। আর এই নিয়েই নিঘার শিফট ম্যানেজার করিমুদ্দিন মিঞার গলায় কেন্দ্রের মোদি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ।
[আরও পড়ুন: সোমেই স্বস্তির কালবৈশাখী, লণ্ডভণ্ড হতে পারে বাংলার ৮ জেলা]
একইভাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বিরোধী, বঞ্চনার হাওয়া ছড়িয়েছে আসানসোলের ৪৯ টি ভূগর্ভস্থ খনিতেই। আর নির্বাচনী উত্তাপের ধাক্কায় রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কেন্দ্র বিরোধী সেই হাওয়ায় আরও জোরালো করার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে স্বাধীনতার পর প্রথম এই আসনে লড়াই করে জয়ী হন কংগ্রেসের দক্ষ সংগঠক ও নেতা অতুল্য ঘোষ। পরে বামফ্রন্টের হারাধন রায় তিনবার, বংশগোপাল চৌধুরী দুবার, বিকাশ রায়চৌধুরীও দুবার এবং শেষে বাবুল সুপ্রিয় ২০১৪ ও ২০১৯ জিতেছিলেন এই কয়লাখনি নির্ভর ভোটের উপর ভিত্তি করেই। সেই কয়লা লবি, খনি শ্রমিকদের ভোট এবার বিজেপির পাওয়া যে খুবই কঠিন তা স্বীকার করছেন আদি বিজেপির নেতারা। দাবদাহের দাপটের মধ্যেই লু কাটিয়ে ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ঘুরতে ঘুরতে যেখানেই যাচ্ছি শুনছি, আসানসোলে ‘কয়লা যার, ভোট তার’।
কয়লাখনি ঘিরে আরও একটি স্থানীয় সমস্যা-প্রভাব রয়েছে। তা হল, একসময় যাঁরা কয়লা মাফিয়া ছিলেন তাঁদের অধিকাংশই এখন বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। কিন্তু ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর কয়লা নিয়ে বিজেপির চাপে সিবিআই তদন্ত শুরুর পর এদের কেউ গ্রেপ্তার, কেউ এলাকাছাড়া। অথচ এই সমস্ত প্রভাবশালীদের নানা প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ চাকরি করেন। স্বভাবতই এই মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের ভোট কিন্তু ওই ‘কয়লা লবি’ নিয়ন্ত্রণ করবে বলে দাবি আসানসোলের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। শুধু তাই নয়, সিবিআইয়ের মামলা ও ইডির নজরদারি ধাক্কায় গত তিন বছর ধরে বারাবনি-কুলটি-জামুড়িয়া-রানিগঞ্জে কুয়ো-খনির অবৈধ কয়লা উত্তোলনও পুরোপুরি বন্ধ। এই কুয়ো-খনি থেকে কয়লা তোলা ঘিরে মোমবাতি বিক্রি, ঘর ভাড়া দেওয়া ও ভাত-ডাল বিক্রির মতো পেশায় যুক্ত ছিল হাজার কয়েক পরিবার। স্বভাবতই তাঁদের রুটিরুজি বন্ধ হওয়ায় মূল ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। স্বভাবতই এই ভোট নিয়েও প্রবল চিন্তায় বিজেপির ভোট ম্যানেজাররা।
বাংলার রাজনীতিতে বিহার-ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা মানেই বিজেপিকে ভোট দেবেন ভেবে যাঁরা অঙ্ক কষেন, তাঁরা কয়লাখনি অঞ্চলে এলে ভুল ভাঙবে। পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভার দাপুটে বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি নরেন চক্রবর্তী তাঁর অফিসের সামনের জমায়েত হওয়া শতাধিক মানুষ দেখিয়ে বললেন, ‘‘এদের অধিকাংশই কিন্তু বিহার-ঝাড়খণ্ডের। কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, পাণ্ডবেশ্বর, বারাবনি, কুলটির মতো যেখানেই খনি আছে সেখানেই তৃণমূল উপনির্বাচনের মতো এবারও রেকর্ড ভোটে এগিয়ে থাকবে।’’ ২০২২ সালের উপনির্বাচনে আসানসোল বিজেপির কাছ থেকে তিন লাখ তিন হাজারের বেশি ভোটের মার্জিনে ছিনিয়ে নেন তৃণমূলের তারকা-প্রার্থী তথা ‘বিহারিবাবু’ শত্রুঘ্ন সিনহা। এবারও ভোট ঘোষণার আগেই তাঁকে প্রার্থী করে পাঠিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নরেন চক্রবর্তী ছাড়াও মন্ত্রী মলয় ঘটক, মেয়র বিধান উপাধ্যায়রা শত্রুঘ্ন যে অবাঙালি ভোট কব্জায় আনার যে পরিকল্পিত রণকৌশল সাজিয়েছেন তা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ বিজেপিকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে যথেষ্ট। বস্তুত সেই কারণে বক্তৃতায় মলয় ঘটককে ‘ম্যাজিক ম্যান’ বলে সম্বোধন করছেন ‘কালাপাত্থর’ সিনেমার হিট চরিত্র ‘মঙ্গল সিং’ শত্রুঘ্ন। রবিবার ছুটির দিনেও আসানসোল রবীন্দ্রভবনে পরপর খ্রিস্টান, নিহারি ও চৌহান সম্প্রদায়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠক ও পরিকল্পনা করলেন শত্রুঘ্ন। উল্টোদিকে প্রতিদিনই মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে প্রণামী বিলিয়ে চলেছেন বিজেপির প্রার্থী।
[আরও পড়ুন: অভিষেকের সভার আগে পাণ্ডুয়ায় বোমা ফেটে কিশোরের মৃত্যু, গুরুতর জখম আরও ২]
খোলামুখ কয়লাখনির এক শিফট ম্যানেজার গলায় তীব্র অসন্তোষ নিয়ে বলছিলেন, ‘‘মোদি সরকার একটাও নতুন চাকরি তো দিচ্ছেই না, উলটে বিদেশিদের হাতে পর পর তুলে দিচ্ছে দেশের খনি, চাকরি হারাচ্ছেন বাঙালি-বিহারি-ঝাড়খণ্ডিরা।’’ কথাটা যে সত্যি তার প্রমাণ পেলাম পাণ্ডবেশ্বর কালীমন্দিরে বিজেপি প্রার্থী সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়ার পুজো দেওয়া ও প্রচার দেখতে যাওয়ার পথে। দেখি রাস্তার পাশে শোনপুর বাজারি কোলিয়ারিতে বিশাল রাশিয়ান যন্ত্র ভূগর্ভ থেকে কয়লা তুলছে। খনি থেকে কয়লা তোলা, ট্রেনে ভর্তি, পুরোটাই মেশিনে হচ্ছে। যন্ত্রের পাশে প্রচুর রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ার থাকলেও হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র ভারতীয়। এমনই ছবি অন্য তিনটি বিদেশি যন্ত্র বসা ভূগর্ভস্থ খনিতে। এগুলির নাম-হাইওয়াল মাইনিং, লংওয়াল মাইনিং, ম্যান রিডিং সিস্টেম। কয়লাখনি এলাকা জুড়ে একটার পর একটা গ্রামে যাচ্ছি, যতই ঘুরছি ততই বিজেপির বিরুদ্ধে এই ক্ষোভের উত্তাপ টের পাচ্ছি। স্বভাবতই গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে রুটিরুজির খোঁজে বাংলার পাশাপাশি বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে যাঁরা আসানসোল তথা কয়লাখনি অঞ্চলে রুটিরুজির জন্য এসেছিলেন এবার তাঁদের মধ্যে কেন্দ্রের বেসরকারীরণের জেরে চাকরির পথ বন্ধ হওয়ার জেরে ১৩ মে চতুর্থ দফার ভোটে ইভিএমে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে।