ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: ‘পদাতিক’-এর পাণ্ডুলিপির খোঁজ নেই। ‘খারিজ’ হয়ে গিয়েছে ‘কলকাতা ৭১’র স্রষ্টার অধিকাংশ চিঠি, দলিল,দস্তাবেজ। ‘রাতভোর’ থেকে ‘আমার ভুবন’-এরকম অন্তত ২৭ টি ছবি করেছিলেন সদ্যপ্রয়াত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন। বানিয়েছিলেন অন্তত চারটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র। এছাড়াও দূরদর্শনের জন্য দু’টি ধারাবাহিক তৈরি করেছিলেন ‘আকাশ কুসুম’-এর স্রষ্টা। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা হল, এই সব কালজয়ী ছবির কোনও পাণ্ডুলিপি নেই তাঁর বেলতলা রোডের বাড়িতে। ১৯৫৬ থেকে ২০০২ সাল। দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে দেশ,বিদেশের অনেক চলচ্চিত্রকার, সমালোচক অথবা বন্ধুরা মৃণাল সেনকে যে সমস্ত চিঠি পাঠিয়েছেন, তারও কোনও খোঁজ নেই। রবিবার এমনটাই জানিয়েছেন মৃণালপুত্র কুণাল সেন। ছবির পাণ্ডুলিপিই বা চিঠিপত্রই শুধু নয়। তাঁর বেলতলা রোডের বাড়িতে অনেক বইয়েরও খোঁজ মিলছে না। নেই বেশ কিছু পদক, পুরস্কার – জানালেন কুণাল সেন।
কিন্তু কোথায় গেল মৃণাল সেনের লেখা পান্ডুলিপি? জবাবে কুণাল জানাচ্ছেন, ‘অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি বাবা নিজেই পুরসভার জঞ্জাল ফেলার গাড়ি ডেকে তুলে দিয়েছিলেন!’ আর বাকি লেখাগুলো? সেগুলো কোথায় গেল? ছেলের জবাব, ‘সেসবেরও কোনও খোঁজ মিলছে না!’ ব্যক্তি মৃণাল সেন কোনও দিনও খুব গোছানো মানুষ ছিলেন না। যখন প্রয়োজন হত, তখনই লিখতেন, পরিকল্পনা ছকে রাখতেন। অধিকাংশ সময়ে ছবির চিত্রনাট্য একবারই লিখতেন, এবং তার ওপর ভিত্তি করেই গোটা সিনেমাটি বানাতেন। ছবির প্রয়োজনে একটা শট অবশ্য একাধিকবার নিতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু ছবি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সেসব গুছিয়ে রাখার কোনও উদ্যোগ ছিল না। নিজের সম্পর্কে কোনও খেয়ালই রাখতেন না বলেও জানিয়েছেন কুণাল সেন। বেলতলা রোডের বাড়িতে বসে কুণাল জানাচ্ছেন, “বেশ মনে আছে, ২০০৩ সালের গোড়ার দিকে বাড়ি বদলের সময় হঠাৎ বাবা সব কাগজপত্র গোছাতে শুরু করলেন। মাও হাত লাগালেন। ক’দিন এসব চলল। তারপর কী মনে হল, ‘ধুস! এসব রেখে কী হবে?’ বলে হাত গুটিয়ে নিলেন।” তারপরই নাকি পুরসভার সাফাই গাড়ি ডেকে সব তুলে দিয়েছিলেন মৃণাল সেন। ততদিনে প্রায় সব ছবি করে ফেলেছেন তিনি। স্মৃতি হাতড়ে কুণাল বলেছেন, “এক পুরকর্মী বলছিলেন, ‘ঠং করে কী একটা শব্দ হল, একটু দেখবেন?’ দেখা গেল, একটা মুখ বন্ধ ব্যাগ থেকে বেরলো কিছু মেডেল আর পুরস্কার। আমার বাবা একবার সেসব দেখে মুখ সরিয়ে নিলেন। সাফাই কর্মী সব তুলে দিয়েছিল জঞ্জাল ফেলার গাড়িতে!”
[ শ্রীদেবীর বায়োপিকের পরিকল্পনা করছেন বনি কাপুর]
অনাবাসী বাঙালি কুণালের কাছে কলকাতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের মূল সূত্রটাই ছিল বাবা তথা ‘বন্ধু’ মৃণাল সেন। কুণালের কথায়, ‘বাবা চলে যাওয়ার পর সেই সুতোটাই ছিঁড়ে গিয়েছে।’এখনও তাঁর বাড়িতে রয়ে গিয়েছে তিনটি আলমারি ভর্তি অন্তত হাজার খানেক বই। এইসব বইয়ের কী হবে? কুণাল বলছেন, ‘এখন সম্ভবত তেমন আর কেউ বেশি বই পড়েন না। তেমন লাইব্রেরিও তো নেই। তাই জাতীয় স্তরে কোনও সংস্থাকে তাঁর সব বই দিয়ে দেব বলে ভেবে রেখেছি।’ প্রায় তিন দশকের বেশি কলকাতার বাইরে কুণাল সেন। পাকাপাকি ফিরে আসারও সম্ভাবনা নেই। ফলে, খুব শীঘ্রই অন্য কারও হাতে চলে যেতে বসেছে ‘কলকাতার এলডোরাডো’র বাকি স্মৃতি।