বিশ্বদীপ দে: মমি (Mummy)। উচ্চারণ করলেই মাথার মধ্যে ছমছমে ভয়ের জলছাপ তৈরি হয়ে যায়। একে অস্বীকারের কোনও উপায় নেই। ছোটবেলা থেকেই আমাদের সবাইকে পেড়ে ফেলে তুতেনখামেনের মমির অভিশপ্ত মিথ। হলিউডের ছবি দেখতে গিয়ে পর্দায় মমির ভয়াল মুখব্যাদান দেখে সিটের ভিতরে সিঁটিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তো অনেকেরই রয়েছে।
এইচ পি লাভক্র্যাফট বলেছিলেন, সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম ভয় হল অজানার প্রতি ভয়। ইতিহাসের মতো অজানাই বা কে আছে? আর মিশর (Egypt) তো চিররহস্যে ঢাকা। সেখানে তাই ভয়ের খাসমহল। মিশরীয় রহস্য রোমাঞ্চের শ্রেষ্ঠতম বক্স অফিস নিঃসন্দেহে মমিই। মৃত্যুর পরেও হাজার হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রাখা মৃতদেহ ঘিরে কৌতূহল জন্মাবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর সেই মমি যদি হয় চিৎকাররত! তাহলে যে রক্ত জল হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
একটি নয়। এমন মমি রয়েছে দু’টি! একটি মহিলা। অন্যটি পুরুষ। এদের ডাকা হয় ‘স্ক্রিমিং মমি’ (Screaming Mummy) নামে। দুটি মমির চেহারাই হিমশীতল আতঙ্কের উদ্রেক করে। হাঁ করা মুখে চিৎকারের আভাস! কেন মারা যাওয়ার আগে চিৎকার করছিল তারা? কোন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তিন হাজার বছরের পুরনো এই জোড়া মমিকে ঘিরে রাখা ইতিহাসের অন্দরে? আজও তা নাড়া দিয়ে যায় সকলকে।
[আরও পড়ুন: নারীশক্তিকে কুর্নিশ, চোখ বন্ধ অবস্থায় ১৫৫ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে নেমে রেকর্ড মায়ের]
১৮৮১ সাল। ইজিপ্টের লুক্সর শহরের দইর এল-বাহারিতে সন্ধান মিলেছিল মহিলা মমিটির। ওই জায়গায় মিশরের একবিংশতম ও দ্বাদশতম রাজবংশের প্রতিনিধিদের সংরক্ষণ করে রাখতেন পুরোহিতরা। সেই মমিদের মধ্যেই ছিল এই মমিটিও। তার মাথা ছিল ডানদিকে কাত করা। পায়ে জড়ানো লিলেন কাপড়। বেশ দামি বস্ত্র, সুগন্ধিতে সাজানো মমিটির মুখের দিকে তাকালে যে কেউ আঁতকে উঠতে বাধ্য। যেন ভয়ানক চিৎকার করে উঠতে চাইছে সে। হাঁ করা মুখের ভিতর দিয়ে দৃশ্যমান দাঁতের সারি। বুজে যাওয়া চোখের কোটরে কোনও এক যন্ত্রণার অসহায় আর্তি। এখানেই শেষ নয়। দইর এল-বাহারিতেই সন্ধান মিলেছিল আরও এক মমির। সেটি পুরুষ মমি। তবে তারও মুখ জুড়ে চিৎকারের ভঙ্গি। বাকি সব মমিদের থেকে একেবারেই আলাদা এই দু’জন। উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই ওই জোড়া মমির রহস্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। কিন্তু উনবিংশ শতকের বিজ্ঞান ততটা অগ্রসর হতে পারেনি। তবে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আর তা ততটা অন্ধকারে নেই।
[আরও পড়ুন: ‘ঘোড়া ছুটিয়ে অফিসে আসতে চাই’, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন সরকারি কর্মচারীর]
বিখ্যাত মিশর বিশেষজ্ঞ ডা. জাহি হাওয়াসের নেতৃত্বে গবেষকরা কাজ করেছেন ওই দুই মমিকে নিয়ে। তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে বহু অজানা তথ্য। জানা গিয়েছে, পুরুষ মমিটি রাজা তৃতীয় রামেসের পুত্র যুবরাজ পেন্টাভেরের। তাকে জোর করে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছিল। এটা ছিল তার ‘শাস্তি’। নিজের বাবাকে খুন করার মতো ঘৃণ্য অপরাধে এই সাজা দেওয়া হয়েছিল যুবরাজকে। তবে সে তৃতীয় রামেসকে হত্যা করতে সফল হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি। ইতিহাসে এই ঘটনা পরিচিত ‘হারেম প্লট’ নামে। এমন এক ঘৃণ্য অপরাধীকে মৃত্যুর পরেও শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। বাকি মমিদের মতো তার ভাগ্যে জোটেনি লিনেন কাপড়। যেমন তেমন করে তার দেহটি সংরক্ষিত করা হয়েছিল। মনে করা হত, এই ধরনের ব্যক্তিরা মৃত্যুর পরে সিধে নরকে যাবে। এদের কোনও রকম সমীহ দেখানোর প্রয়োজন নেই।
এ তো গেল পুরুষ মমিটি। আর ‘দ্য স্ক্রিমিং উওম্যান মমি’? তাকে অবশ্য চিহ্নিত করা যায়নি। যদিও তার শরীরকে আবৃত করে রাখা লিনেনে কাপড়ে সাংকেতিক ভাষায় লেখা ছিল ‘রাজকন্যা ও রাজ পরিবারের বোন মেরিতামেন’। কিন্তু ওই নামে বহু মিশরীয় রাজকন্যার কথা জানা যায়। ফলে এই রাজকন্যাকে আর শনাক্ত করে ওঠা যায়নি। এই মমিটির সিটি স্ক্যান করে দেখা গিয়েছে, মারা যাবার বয়স রাজকন্যার বয়স ছিল ষাটের কোঠায়। যুবরাজ পেন্টাভেরের মতো দুরবস্থা হয়নি তাঁর। রীতিমতো সযত্নে আর পাঁচটা মমির মতোই সংরক্ষণ করা হয়েছিল তাঁর মরদেহ। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে ধমনির অসুখে ভুগে অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু কেন চিৎকারের ভঙ্গি রয়ে গিয়েছে এই দুই মমির মুখের মধ্যে? সত্যিই কি তাঁরা চিৎকার করছিলেন? বিশেষজ্ঞরা অবশ্য তা মনে করছেন না। নৃতত্ত্ববিদ অ্যান্ড্রু ওয়েডের মতে, এর পিছনে রয়েছে ‘রিগার মর্টিস’। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে দেহের পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া। তাঁর কথায়, ”মাধ্যাকর্ষণের কারণে পেশি ও লিগামেন্টের এমন অবস্থা হওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। হয়তো সংরক্ষণের আগে দেহ শুষ্ক করার সময় চোয়ালের আশপাশের অঞ্চলের নরম কোষগুলি পাতলা হয়ে গিয়েছিল।” এর ফলে নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ায় ব্যাপারটা চিৎকারের আকার নেয়। আসলে এই মমি দু’টিকে সংরক্ষিত করা হয়েছিল দ্রুত। সাধারণত কাউকে মমি করার আগে বেশ সময় নিয়ে দেহটি প্রস্তুত করা হত। ফলে রিগার মর্টিস পেরিয়ে দেহ শিথিল হওয়ার সময় পেত। ফলে চট করে বিকৃতি আসত না দেহতে। কিন্তু এক্ষেত্রে দ্রুততার সঙ্গে দেহগুলিকে সংরক্ষণ করাই তাদের মুখব্যদান জুড়ে চিৎকারের স্থায়ী রেশ সৃষ্টি করেছে।
কারণটা যাই হোক, কোনও সন্দেহ নেই ওই বিচিত্র মুখভঙ্গিই মমি দু’টিকে ‘বিশেষ’ করে তুলেছে। তাদের নীরব চিৎকার যেন কী এক না বলা কথা বলে উঠতে চাইছে তিন হাজার বছর আগের পৃথিবী থেকে! সেই সুদূরের সংলাপ শুনতে আজও তাই কান পাততে চায় কল্পনাপ্রবণ মন। ইতিহাসের শরীর খুঁড়ে তুলে আনতে চায় অজানা রহস্যের খোঁজ।