কবীর সুমন: ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার কিছু পর থেকেই ভারতের কোনও পুলিশ ফাঁড়িতে আমাদের আশ্চর্য নেতার ছবি টাঙানো হয়নি। যুদ্ধ অপরাধী তিনি। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করেছিলেন। ছেলেবেলায় শুনতাম, ভারত তখন মাত্র ক’বছর হল স্বাধীন, আশ্চর্য নেতা আসলে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। কিন্তু ভারতে ফিরলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধী’ হিসাবে তাই তিনি ভারতে ফিরছেন না।
‘আপনার অমুক লেখাটি আমাদের নীতির সঙ্গে মেলেনি বলে আপনাকে আমরা ৩০ দিনের জন্য আটকে দিলাম।’ একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কের নিষেধ-বয়ান।
[‘সিরিয়া নয়, মানবতার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সন্ত্রাসবাদী পাকিস্তান’]
ভারতের ইতিহাস এবং আমাদের কপাল অবিভক্ত ভারতের এক আশ্চর্য নেতার খবরাখবর আটকে রেখেছে তো রেখেছেই! আশ্চর্য নেতা, কারণ, খোঁজখবর নিয়ে যা বুঝেছি, ভারতের কয়েকজন নেতা ছাড়া আর সবাই তাঁকে ভালবাসতেন, এখনও বাসেন, সম্ভবত ভবিষ্যতেও বাসবেন। কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। একবার সভাপতি নির্বাচনে তাঁর কাছে মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় প্রার্থী হেরে যাওয়ায় মহাত্মা বললেন, ‘অমুকের পরাজয় আমারই পরাজয়।’ এই বলে তিনি বানপ্রস্থে চলে যাওয়ার উপক্রম করলেন। বললেন, ‘চললাম।’ সেই আশ্চর্য নেতা তখন বললেন, ‘ওমা, তা কেন, আমিই বরং যাই!’ সেরকম মানুষ হলে সেই আশ্চর্য নেতা নিরাসক্ত মুখ করে বলতেন, ‘আসুন।’ সংখ্যাগুরুর সমর্থন তাঁরই দিকে। বলতেই পারতেন।
ভাবনাটা হল– অহিংসার প্রফেট (যিনি, তাঁর ক্যান্ডিডেট ভোটে হেরে গেলেন বলে দল ছেড়ে দেওয়ার ‘সহিংস’ হুমকি দিলেন) যদি সরে যেতেন, ভারতের ইতিহাস কেমন হত? আশ্চর্য নেতা ও তাঁর অনুগামীরা যদি বলতেন- কী আর করা যাবে, যেতে চান যান, আমরা বলছি থাকুন, আপনি বলছেন না থাকব না, তাহলে কী আর করা যাবে, আপনি আসুন, ভাল থাকুন, আমাদের লড়াই জারি থাকবে। কী হতে পারত, কী হত যদি- এভাবে কোনও যুক্তিনিষ্ঠ কথা হতে পারে না। খোশগল্প হতে পারে বড়জোর। আমাদের ইতিহাস খোশগল্প নয়। যদিও ইদানীং, যা দেখছি, প্রায় সেদিকেই যাচ্ছে।
‘আজাদ হিন্দ সরকার’-এর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রীনরেন্দ্র মোদি তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করলেন আজাদ হিন্দ টুপি পরে। ১৯৪৫ সালে ‘আরএসএস’-এর মারাঠি মুখপত্র একটি কার্টুন ছাপে। মহাত্মা গান্ধী, খাটো ধুতি পরে চাদর গায়ে, তাঁর হাতের লাঠি খসে পড়েছে সম্ভবত আঁতকে উঠে। দশটি মাথা তাঁর। সেই আশ্চর্য নেতার মাথাও রয়েছে তার মধ্যে। দশমাথাওলা মহাত্মা গান্ধীর সামনে তির-ধনুক হাতে সাভারকর, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে থাকবেন না বলে মুচলেকা দিয়েছিলেন এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি যত না ব্রিটিশ বিরোধী, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি ‘মুসলিম বিরোধী’। দুই আরএসএস বীর তাঁদের ধনুকের ছিলা টেনে ধরে তির তাক করছেন মহাত্মার দিকে। এই ছুড়লেন বলে! দু’জনের দু’টি তির কি শুধু মহাত্মার বুক লক্ষ্য করে? বলা যায়, অবিভক্ত ভারতের অন্তঃস্তল টিপ করে।
ভারতের ভাগ্যবিধাতা যেন গাছে-গরু-চড়ানো গল্পকার। শ্যামাপ্রসাদ-সাভারকরের তির দু’টি কোথায় গিয়ে লাগল– সেই ছবি আরএসএস-এর মারাঠি মুখপত্রে ছাপানো হয়েছিল কি না, জানি না। জানি, ওই ছবিটি ফিল্মি ভাষায় স্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট হয়ে মিশে যাচ্ছে মাননীয় শ্রীনরেন্দ্র মোদির ছবিতে, মাথায় আজাদ হিন্দ টুপি। ভাগ্যিস সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ দেখতে পেলেন না এই দৃশ্য। ওই টুপি পরে আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তেরঙ্গা পতাকা তুলছেন লাল কেল্লায়- যেখানে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার হয়েছিল। সেই বিচারে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু উকিলের জোব্বা পরে ফৌজের পক্ষ নিয়ে ওকালতি করতে নেমেছিলেন। কোনও সওয়ালে তিনি অংশ নিয়েছিলেন কি?
ঠ্যালার নাম বাবাজি। ঠ্যাকায় পড়ে কত কী করতে হয়! আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের সময়ে গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ফুঁসে উঠেছিল গণরোষ। বিচারে ফৌজের পক্ষ নিয়ে ওকালতি করার ছবিটা সেই যুগমুহূর্তের মুখ লক্ষ করে ছুড়ে দিতে না পারলে পণ্ডিত জওহরলাল ও তাঁর দলের জন্য পরিণাম ভাল হত না। আমার প্রফেট সুকুমার রায় লিখেছিলেন– ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি…’। গণতন্ত্রের পয়লা নম্বর শ্লোক বলছে – ‘ভোটের আমি ভোটের তুমি ভোট দিয়ে যায় চেনা’। আমাদের রাজ্যে একটি হিন্দু সম্প্রদায় থাকে, যাদের প্রধানের হাতে অনেকগুলি ভোট। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এক কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদেরও (যাঁরা নাকি নাস্তিক) সেই ভোটগুলির লোভে সম্প্রদায়-কর্ত্রীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হয়েছিল। হাত তুলে নমস্কার নয়, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম। ভোটের পায়ে ভোটের প্রণাম ভোটের জন্য সব।
ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিজেপি, আরএসএস মনে করছে কংগ্রেসকে ধাক্কা দিতে গেলে এখন মুখে নিতে হবে সেই আশ্চর্য নেতারও নাম, যিনি কিন্তু ১৯৪০ সালে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছে। ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলেই হিন্দু মাত্রই শির নত। ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেই এর নিন্দা করা কর্তব্য। এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনার রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন। এদের কথা শুনবেন না।’
আমাদের আশ্চর্য নেতার এই কথাগুলি কি আমরা আজ আবার মনে করব? সম্ভব হলে ছোট ছোট কাগজে লিখে নিজেদের ঘরে নানা জায়গায় রেখে দেব যাতে চোখে পড়েই পড়ে? সে না হয় হল, কিন্তু খোদ আশ্চর্য নেতার সম্পর্কে খবরাখবর যে আটকে আছে। কোথায় কোথায় ও কেন, তা আমাদের রাষ্ট্রই জানে। ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার কিছু পর থেকেই ভারতের কোনও পুলিশ ফাঁড়িতে আমাদের আশ্চর্য নেতার ছবি টাঙানো হয়নি। যুদ্ধ অপরাধী তিনি। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করেছিলেন। ছেলেবেলায় শুনতাম, ভারত তখন মাত্র ক’বছর হল স্বাধীন, আশ্চর্য নেতা আসলে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। কিন্তু ভারতে ফিরলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধী’ হিসাবে তাই তিনি ভারতে ফিরছেন না। কত গল্প যে শুনেছি! কখনও শুনেছি তিনি সাধুর ছদ্মবেশে হাজির হয়েছেন। কখনও– তিনি ছিলেন সাইবেরিয়ায় জোসেফ স্তালিনের বন্দি। সাধুর বেশই ধরে থাকুন আর সাইবেরিয়ায় বন্দিই থাকুন, আশ্চর্য নেতা সম্পর্কে কোনও খবরই সোজা পথে সটান আসেনি, আসে না, আসতে পারে না। সব রাস্তাই বন্ধ। আটকা।
তারই মধ্যে আশ্চর্য নেতার আজাদ হিন্দ ফৌজের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই বাহিনীর টুপি পরে পতাকা উত্তোলন করলেন। অলৌকিকভাবে তাঁর সঙ্গে আমাদের আশ্চর্য নেতার হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে– বালাই ষাট – পরিণাম খুব সুখকর হত বলে মনে হয় না। তেমনই ভূতের মুখে রামনামের চেয়েও যা বেশি অবাক-করা: বিজেপি নেতৃত্বের মুখে বাবাসাহেব আম্বেদকরের সঙ্গে সারা উপমহাদেশের আশ্চর্য নেতার নামও শোনা যাচ্ছে। উদ্দেশ্য কংগ্রেসের উপর একহাত নেওয়া। সবই ভোট-দেবতার লীলা। সেই লীলার কোনও এক ফাঁকে কি ফন্দিপিসির দিল্লিবাক্সে লুকিয়ে রাখা আমাদের আশ্চর্য নেতার কিছু খবর নোটবন্দি-নেতা প্রকাশ করে দেবেন?
[ঐতিহ্য ফেরাতে পুতুলনাচ শিল্পীদের ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ হাসিনা সরকারের]
The post ফন্দিপিসির দিল্লিবাক্সে বন্দি আশ্চর্য নেতার খবর appeared first on Sangbad Pratidin.