স্টাফ রিপোর্টার: ঘটনা এক। ভোর ৪টে ৩৫। সেমিনার হল থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
ঘটনা দুই। সকাল ৬টা। ফের সেমিনার হলে যাওয়া।
ঘটনা তিন। মাঝের ঘণ্টা দেড়েক। আর জি কর হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো। হয়তো ঘটনা পরম্পরার দিকে নজর রাখা।
ঘটনা চার। সকাল সাড়ে ৬টার কিছু আগের মুহূর্ত। আর জি কর ছেড়ে চতুর্থ ব্যাটালিয়নের বারাকের দিকে চলে যাওয়া।
ভয়ংকর ‘সে দিন’-এর ভোররাতটা অনেকটা এমনই ছিল ধৃত সঞ্জয় রাইয়ের। অন্তত, তদন্তের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এমনটাই জানাচ্ছে সিবিআইয়ের একটি সূত্র। যার মোদ্দা কথা, সে দিন সকাল হতেই ফের চারতলার সেমিনার হলে গিয়েছিল অভিযুক্ত সঞ্জয়।
কিন্তু, কেন?
হয়তো হারিয়ে যাওয়া ব্লু-টুথ ইয়ারফোনের খোঁজ পেতে। হয়তো বা সামগ্রিক পরিস্থিতি কেমন তা বুঝে নিতে। বা অন্য কোনও কারণ।
[আরও পড়ুন: সায়নের জামিনের বিরোধিতা, সুপ্রিম কোর্টে খারিজ রাজ্যের মামলা]
পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। সিবিআই আধিকারিকদের মতে, অপরাধ ঘটানোর পর বহু অপরাধীর মধ্যে ফের অপরাধস্থল বা ঘটনাস্থলে ফিরে আসার প্রবণতা থাকে। তদন্তকারীদের মতে, মূলত সেই কারণেই সঞ্জয় সহজে আর জি কর চত্বর ছাড়তে চায়নি। আসলে তার নজর ছিল চারতলার সেমিনার হলের দিকে। সেখানে কেউ এসে নির্যাতিতার দেহটি দেখেছেন কি না– সে দিকে নজর রাখতেই অন্যান্য তলার করিডর ও সিঁড়ির কাছে ঘুরে বেড়ায় সে। কারণ, সঞ্জয় জানত তরুণীর দেহ কেউ দেখতে পেলে চেঁচামেচি হবেই।
সিবিআইয়ের অনুমান, হারিয়ে যাওয়া ব্লু টুথ ইয়ারফোন খুঁজতেই ঘটনার ঘণ্টা দেড়েক পর আর জি কর হাসপাতালের সেমিনার হলে ফিরে এসেছিল সঞ্জয় রাই। সেটি খুঁজে না পেয়ে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে যায় সে।
উল্লেখ্য, ঘটনার একদিনের মধ্যেই এই ব্লু টুথ ইয়ারফোনের সূত্র ধরেই সঞ্জয়কে গ্রেপ্তার করেছিল কলকাতা পুলিশ। সূত্রের খবর, এই ব্যাপারে যখন সিবিআই সঞ্জয়কে জেরা করে, তখন সে বিভ্রান্তিমূলক বয়ান দিতে থাকে। তাই হাসপাতালে সঞ্জয়ের গতিবিধির ব্যাপারে নিশ্চিত হতে সিবিআই একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছে।
জেরার কখনও সঞ্জয় বলেছিল, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর সে ভোর ৪টে ৩৫ মিনিট নাগাদ সেমিনার হল থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু, আর জি কর ছেড়ে চলে না গিয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘোরাফেরা করতে থাকে। তদন্তকারীদের অনুমান, বেশ কিছুক্ষণ পর সঞ্জয় বুঝতে পারে, তার গলায় যে ব্লু টুথ ইয়ারফোনটি ছিল, সেটি নেই। এর পরই সঞ্জয় হাসপাতালের বিভিন্ন তলায় ঘুরে ঘুরে তার ইয়ারফোনটি খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু সেটি সে পায়নি...
সিবিআইয়ের ধারণা, হারিয়ে যাওয়া ব্লু টুথ ইয়ারফোনটির সূত্র ধরে পুলিশ তার সন্ধান পেতে পারে, সে আশঙ্কা সঞ্জয় করেছিল। তাই সেটি খুঁজে পেতে এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। সিবিআইকে সঞ্জয় রাই জানায়, সকাল ৬টা নাগাদ সে ফের সেমিনার হলে যায়। তখনও আশপাশে কাউকে দেখতে পায়নি। তখন সরাসরি হলের ভিতর প্রবেশও করে।
[আরও পড়ুন: জম্মুর সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলা! গুরুতর আহত জওয়ান, নির্বাচনের প্রাক্কালে বাড়ছে উদ্বেগ]
অবশ্য এ প্রসঙ্গে সিবিআইকে বেশ কয়েকবার বিভ্রান্তিমূলক বয়ান দেয় ধৃত। একবার জানায়, সেমিনার হলের ভিতরে কোনও দেহ সে দেখতে পায়নি। কিন্তু জিনিসপত্র ছড়ানো-ছেটানো অবস্থায় ছিল। আবার পরে জেরার মুখে সে এ-ও বলে, ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে হলের অবস্থা একইরকম ছিল। কখনও বলে, পুলিশ পরিবারের এক রোগীকে খুঁজতেই ভোরের আলো ফোটার পর ট্রমা কেয়ার ও একাধিক অপারেশন থিয়েটারে যায়। কিন্তু কোথাও তাঁকে সে পায়নি। পক্ষান্তরে সিবিআইকে এমনও বলে, অপরাধটি ঘটানোর পর একবার আর জি করের বাইরে গিয়ে ফের মদ্যপান করে। তার পর হাসপাতালে ফিরে আসে। ঠিক এই প্রেক্ষিতেই সিবিআইয়ের অনুমান, ফের নির্যাতিতার দেহের কাছে গিয়ে ব্লু টুথ ইয়ারফোনটি খোঁজার চেষ্টা চালায় সঞ্জয়। কিন্তু তাড়াহুড়োয় সেটি খুঁজে পায়নি। তদন্তকারীদের অনুমান, “যেহেতু সকাল হয়ে গিয়েছিল, তাই ঘরের মধ্যে কেউ চলে আসতে পারেন, এই আশঙ্কাতেই দ্রুত সেমিনার কক্ষ ছাড়ে সঞ্জয়।”
প্রসঙ্গত, সঞ্জয় রাইয়ের ফেলে আসা ‘সেই’ ব্লু টুথ ইয়ারফোনের সূত্র ধরেই কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। পলিগ্রাফ পরীক্ষার সময়ও এই ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য তার কাছ থেকে জানার চেষ্টা হয় বলে জানিয়েছে সিবিআই।