ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: ডেঙ্গুর নেপথ্যে ভাইরাস (Virus)। তাই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে রোগীর শরীরের ধাত বুঝে ততটাই ওষুধ দিতে হবে। বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যু হয় অতিমাত্রায় চিকিৎসার কারণে। কখনও লাগামছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotic), আবার চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া স্যালাইন দেওয়া এবং শেষ ও বড় কারণ – বিনা প্রয়োজনে প্লেটলেট দেওয়া। মূলত এই তিনটি কারণে ডেঙ্গু রোগীর প্রাণ সংশয় হয়। রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সমীক্ষা চালিয়ে এই তথ্য হাতে এসেছে বিশেষজ্ঞদের।
ডেঙ্গু (Dengue) রোগীকে অহেতুক, অপ্রয়োজনে প্লেটলেট দেওয়ার জেরে অসংখ্য রোগীর প্রাণসংশয় হচ্ছে রোজ। এঁদের একটা বড় অংশ ফুসফুসে জল জমে, হার্ট ফেলিওর হয়ে মারাও যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের একাংশের সন্দেহ, এমন ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটছে বেসরকারি হাসপাতালে। স্বাস্থ্যভবনের হিসাব বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্তের মৃত্যু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটছে বেসরকারি হাসপাতালে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা শরীরের জলশূন্যতা। রক্তে কমে যায় অণুচক্রিকা বা প্লেটলেট (Platelate)। আবার রক্তবাহিকা থেকে রক্তরস বা প্লাজমা লিক করে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে রক্ত ঘন হয়ে ওঠে। সবক’টি ক্ষেত্রেই আইভি ফ্লুইড (স্যালাইন) চলার কথা। কিন্তু ঠিক কোন সময়ে কতটা স্যালাইন দিতে হবে, আর কখন দেওয়া হবে প্লেটলেট, তা নিয়ে সরকারি নির্দেশিকা থাকলেও অনেক বেসরকারি হাসপাতালে সেটা ঠিকমতো মানা হচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী।
[আরও পড়ুন: ডায়মন্ড হারবারে শুটআউট, ভাইফোঁটায় দিদির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খুন ভাই]
সরকারি হাসপাতাল সূত্রে খবর, জ্বরের রোগীর ভিড়ে সেখানেও কয়েকজন চিকিৎসক নিয়মিত ব্যবধানে কখন কাকে কতটা ফ্লুইড কিংবা প্লেটলেট দিতে হবে, দেওয়া হলে কখন তা কমানো বা বন্ধ করতে হবে, সে সব পরখ করার সময় পাচ্ছেন না। ফলে বোঝা যাচ্ছে না রোগীর প্রকৃত অবস্থা। এতে বেশ কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অতি-চিকিৎসায় হিতে বিপরীত হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্তারা মনে করছেন, ডেঙ্গু চিকিৎসার প্রোটোকল সরিয়ে রেখে চিকিৎসা হচ্ছে অনেক জায়গায়৷ সে জন্যই ফ্লুইড ওভারলোড আর প্লেটলেট সঞ্চালন সংক্রান্ত জটিলতা বেড়ে যায়।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (Kolkata Madical College Hospital) ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রসূন ভট্টাচার্য জানান, ডেঙ্গুতে প্লেটলেট ২০ হাজারের নীচে যদি যায় এবং রক্তক্ষরণ হতে থাকে, তখনই কেবল প্লেটলেট দেওয়ার কথা। আর প্লেটলেট ১০ হাজারের নিচে গেলে রক্তক্ষরণ হোক বা না হোক, একমাত্র তখনই প্লেটলেট দিতে হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তাদের ক্ষোভ, বহু জায়গাতেই ৫০-৬০ হাজারেও প্লেটলেট দিয়ে দেওয়া হচ্ছে লাগামছাড়া ভাবে। ফল হচ্ছে মারাত্মক।
[আরও পড়ুন: বিরাট-শামির মহা-ভারত! হাজার কণ্ঠের বন্দে মাতরমে কাঁপল ওয়াংখেড়ে]
মুকুন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিসিন (Medicine) বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বিশ্বাস জানান, যে কোনও রক্ত বা রক্ত উপাদান সঞ্চালনেই কিছুটা ঝুঁকি থাকে। অপ্রয়োজনে সেই ঝুঁকি নিলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। অরিন্দমের কথায়, ‘‘দরকার ছাড়া অণুচক্রিকা দিলে প্লেটলেট বাড়ার বদলে উল্টে কমে যেতে পারে। এমনকী, এর জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ফুসফুসও। প্রবল জ্বর আর খিঁচুনি হয়ে প্রাণঘাতী পরিস্থিতিও তৈরি হয়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, আগাম প্লেটলেট দিলে কোনও লাভ হয় না।’’
ফর্টিস হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার ডা. সুচন্দ্রা গোথরের কথায়, স্বাস্থ্যভবনের তৈরি প্রোটোকল মেনে চললে রোগী অবশ্যই সুস্থ হবে। তিনি বলেন, “গড়ে ঘণ্টায় ১০০ মিলিলিটার ফ্লুইড চালানোর কথা এবং ১-৩ ঘণ্টা অন্তর নিয়মিত রোগীর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা দরকার। অন্যথায়, ফ্লুইড ওভারলোডের কারণে ফুসফুসের ভিতর জল জমে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।” তিনি জানাচ্ছেন, হৃদপেশি দুর্বল হলে ফ্লুইড ওভারলোডের কারণে অতিরিক্ত হার্ট ফেলিওর হয়ে অঘটন একেবারেই বিরল নয়।