সুমিত বিশ্বাস,পুরুলিয়া: আট বছর আগে কোটশিলার টাটুয়াড়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন ওই এলাকার মানুষজন। কিন্তু শিক্ষা নিল না বনদপ্তর! পুরুলিয়া বনবিভাগের কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিটে তিন তিনটি চিতাবাঘের বাসস্থান। তার মধ্যে একটি স্থায়ী। অথচ সেই সিমনি বিট থেকে কোটশিলা রেঞ্জ। এমনকী পুরুলিয়া বনবিভাগেরও বন্যপ্রাণ মোকাবিলায় পরিকাঠামো একেবারেই নগণ্য।
ঝাড়খণ্ড লাগোয়া সিমনি বিট থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে কোটশিলা রেঞ্জে রয়েছে একটিমাত্র খাঁচা আর কয়েকটি জাল। আর সিমনি থেকে প্রায় ৫৫ কিমি দূরে পুরুলিয়া বনবিভাগে যেখানে পৃথক ‘ওয়াইল্ড লাইফ স্কোয়াড’ রেঞ্জ রয়েছে সেখানে মাত্র একটি ট্রাঙ্কুলাইজার গান, দু’টি খাঁচা আর কয়েকটি জাল। এই রেঞ্জে একমাত্র আধিকারিক ছাড়া আর কেউ নেই।
হঠাৎ করেই যদি চিতাবাঘ গ্রামে ঢুকে পড়ে। কিংবা জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামে এসে গবাদি পশুকে টেনে নিয়ে যায় বা মানুষের মুখোমুখি পড়ে হামলা চালায়, তাহলে পরিস্থিতি কী হতে পারে, এই পরিকাঠামো থেকেই পরিষ্কার। একেবারে ‘ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দারে’র মতোই অবস্থা পুরুলিয়ার কোটশিলা রেঞ্জ থেকে পুরুলিয়া বনবিভাগের। কিন্তু সিমনি বিটের মানুষজন আট বছর আগের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে চিতার ঘর-সংসারকে কার্যত আগলে রেখেছেন।
[আরও পড়ুন: ফুলশয্যার রাত কাটতে না কাটতেই নববধূর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার, মৃত্যুর কারণ নিয়ে রহস্য]
অভিযোগ, মূলত পুরুলিয়া বনবিভাগের উদাসীনতাতেই কোটশিলা বনাঞ্চলের এমন হাল। যে বনাঞ্চলের জঙ্গলে একটি স্থায়ী-সহ তিন তিনটি চিতার বাসস্থান। সেই রেঞ্জের আধিকারিকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আরেকটি রেঞ্জ প্রায় ৩০ কিমি দূরে আড়শা বনাঞ্চলে। কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিটের মানুষজনের সচেতনতায় চিতাবাঘ-মানুষের সংঘাত বাঁধছে না ঠিকই, কিন্তু লোকালয় ঘেঁষেই এই বন্যপ্রাণ থাকতে বেশি ভালবাসে স্রেফ শিকারের লোভে। জনবসতি ছুঁয়ে থাকলে গরু, মহিষ, মুরগি, ছাগল, সারমেয় সহজেই তারা শিকার করতে পারবে। এই সব কিছু বনদপ্তর জানা সত্ত্বেও উদাসীন চরমে। এই কয়েকদিন আগেই কোটশিলা বনাঞ্চলের নোয়াহাতু বিটের ডামরুঘুটু গ্রামে ফিশিং ক্যাটকে ঘিরেই হুলুস্থুল বেঁধেছিল। চাউর হয়ে গিয়েছিল ‘বাঘের বাচ্চা’ ঢুকে পড়েছে গ্রামে।
আট বছর আগে ২০১৫ সালের ২০ জুন কোটশিলা বনাঞ্চলে নোয়াহাতু বিটের টাটুয়াড়া গ্রামে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছিল একটি পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘ। সেই চিতা বাঘকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মেরেছিল এলাকার মানুষজন। তার পায়ের নখ উপড়ে, লেজ কেটে এমনকী পুরুষাঙ্গও কেটে নিয়েছিল। শাস্তির মুখে পড়েছিলেন বনকর্তা। এতসব কিছুর পরেও হুঁশ নেই কোটশিলা বনাঞ্চল-সহ পুরুলিয়া বনবিভাগের। সিমনি বিট থেকে কোটশিলা রেঞ্জ-সহ পুরুলিয়া বনবিভাগের বন্যপ্রাণ মোকাবিলায় পরিকাঠামো বাড়াতে কোন আবেদনও করা হয়নি বলে অভিযোগ। কিন্তু রাজ্য বনবিভাগ পুরুলিয়া বন বিভাগের পরিকাঠামো শূন্যের কথা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই রাজ্যের বনবিভাগের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “বন্যপ্রাণ মোকাবিলায় কোটশিলা বনাঞ্চলে যাতে পরিকাঠামো বাড়ানো যায় সে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। ওখানে আমরা একাধিক খাঁচা, জাল-সহ সমস্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করব।”
সিমনি বিট-সহ কোটশিলা বনাঞ্চলে ট্রাঙ্কুলাইজার গান চালানোর এক্সপার্ট পর্যন্ত নেই। অথচ বছর তিনেক আগে পুরুলিয়ার সুরুলিয়াতে বনকর্মীদেরকে নিয়ে ট্রাঙ্কুলাইজার গানের একটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা সিমনি ও কোটশিলা বনাঞ্চলে নেই। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল পর্যন্ত একাধিক চিতাবাঘ বনদপ্তরের ট্র্যাপ ক্যামেরায় বন্দি হওয়ার পর শুধুমাত্র একটি খাঁচা পায় এই কোটশিলা বনাঞ্চল। এছাড়া পুরুলিয়া ডিভিশনের তরফে কোনও বিন্দুমাত্র পরিকাঠামো দেওয়া হয়নি। তাছাড়া প্রায় সাত-আট মাস ধরে কোটশিলা বনাঞ্চলে সেভাবে কোন নজরদারিও চলছে না বলে অভিযোগ। চলতি বর্ষার মরশুমে ওই সিমনি বিটের জঙ্গলে নতুন করে বসানো হয়নি কোন ট্র্যাপ ক্যামেরাও। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের গতিবিধির কোনও খবরই নেই বনদপ্তরের কাছে। ট্র্যাপ ক্যামেরায় শেষ ছবি ধরা পড়েছিল ১৩ ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩। এই জঙ্গল ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে মিশে থাকায় ওই বন্যপ্রাণ নিয়ে আশঙ্কার মধ্যেই থাকতে হয়। তবুও একেবারে ঢিলেঢালা কোটশিলা বনাঞ্চল থেকে পুরুলিয়া বনবিভাগ।