রমণী বিশ্বাস, তেহট্ট: চরম সহিষ্ণুতা আর ধৈর্য! গরম তেলের কড়াই থেকে খালি হাতে তোলা হচ্ছে লুচি! তা উৎসর্গ করা হবে ঠাকুরের পুজোয়। প্রত্যেক বছর রীতি মেনে মাঘের পয়লা তারিখে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের তেহট্টে (Tehatta)চলে আসছে স্বপ্নাদেশে পাওয়া এই কালীপুজো (Kali Puja)। এই পুজো বর্তমানে কালাচাঁদের পুজো নামে পরিচিতি পেয়েছে।
লুচির পোশাকি নাম আন্দোস। আতপ চালের গুঁড়ো, কাঁচা দুধ, গুড় মিশিয়ে মাটির মালসায় টগবগে গরম ঘিতে ভাজা হয় এটি। আর এই লুচি দিয়ে হচ্ছে পূজার মূল উপকরণ। বিশেষ করে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর আদিবাসীরা (tribal)মাঘ মাসের এক তারিখে ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে গোবর লেপন করেন। এরপর বাড়িতে দেওয়া হয় আলপনা। সকালে ঠিক সূর্যোদয়ের সময় স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে পূজাপর্ব শুরু হয়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের তেহট্ট থানার নফরচন্দ্রপুর গ্রামে আদিবাসীরা এই পূজা করে আসছেন বছরের পর বছর।
[আরও পড়ুন: সেক্স টয় কিনতে গিয়ে প্রতারকের ফাঁদে পা! লক্ষাধিক টাকা খোয়ালেন জলপাইগুড়ির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক]
যাঁর নামে এই পুজো, সেই কালাচাঁদ সর্দারের কন্যা গ্রামের বৃদ্ধা শ্রীমতি সর্দার জানান, ”আমরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। বন্য প্রাণী শিকার করে চলত দিনযাপন। সে দেশভাগের আগের কথা। অধুনা বাংলাদেশের মেহেরপুর থানার শাল্কী শ্যামপুর গ্রামের কাজলা নদীর ধারে ছিল বসবাস। একদিন বাবা দল বেঁধে শিকার করার সময় গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি পাথরের উপর মা কালীর মূর্তি দেখতে পায়। সেই সময় সকলের নজর ছিল পশু শিকারের, সেই কারণে কালী মায়ের মূর্তি যুক্ত পাথরখণ্ডটি অবহেলায় ফেলে দিয়ে সকলেই শিকারের উদ্দেশ্যে চলে যায়। পরপর কয়েক দিন রাত্রে বাবাকে মা কালী স্বপ্নাদেশে বলেন, ‘তোরা যে পাথরখণ্ডটি অবহেলায় ফেলে রেখে চলে গেছিস, সেই পাথরখণ্ডটি জঙ্গল থেকে নিয়ে এসে গ্রামে প্রতিষ্ঠা কর। সেই থেকে ওই গ্রামে ওই পাথর মূর্তিতে মাঘ মাসের এক তারিখে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ পূজা শুরু করেন।’ দেশভাগের পর পিতা কালাচাঁদ সর্দার পাথরের মূর্তিটি আনতে না পারলেও বেদির মাটি নতুন বস্ত্রে ভরে তেহট্ট থানার খাঞ্জিগোপালপুর গ্রামে বেদি তৈরি করে পুজো শুরু করেন।”
এর কিছুদিন পরে কালাচাঁদ সর্দারের মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর তার ছেলে শৈলেন সর্দার একই নিয়মে সেই বেদির মাটি নিয়ে এসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নফরচন্দ্রপুর গ্রামে বেদি তৈরি করে পুজোর প্রচলন করেন। সেই থেকে খোলা আকাশের নিচে এই বেদিতেই হয়ে আসছে পুজো। যিনি এই পুজো করেন, তাঁকে বলা হয় – দেয়াসি।
[আরও পড়ুন: বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, পাঁচ রাজ্যের ভোট নিয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিল নির্বাচন কমিশন]
বর্তমানে এই পুজোর দায়িত্বভার রয়েছে কালাচাঁদের নাতি দেয়াসি বাবলু সর্দারের উপর। তিনি বলেন, এই পুজো মূলত আমাদের বংশ পরম্পরায় মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাঘ মাসের এক তারিখে বাংলাদেশের মেহেরপুরে শাল্কী শ্যামপুর গ্রামে এই কালাচাঁদের পুজো হয়ে আসছে। এছাড়াও তেহট্টের খাঞ্জিগোপালপুর, বর্ধমান জেলাতেও পুজো হচ্ছে। কালাচাঁদের পুজোর এই বেদীতে মানত করে শত শত মানুষের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। তাই বর্তমানে এই পুজো আর আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সমস্ত ধর্মের মানুষ এই পুজোতে অংশগ্রহণ করেন।