সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সরকারি কাজে ইংরেজি নয়, আরও বেশি করে ব্যবহার করা হোক হিন্দি। দেশের সংহতি আরও মজবুত করতে ইংরেজিকে সরিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হোক হিন্দিকে। সংসদীয় সরকারি ভাষা কমিটির ৩৭তম বৈঠক শেষে এমনই বার্তা দিয়েছেন কমিটি প্রধান তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর এহেন বার্তাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে, নিন্দা, প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অভিযোগ, শাহের বক্তব্যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বিদেশি ভাষার পরিবর্তে দেশীয় ভাষার আরও প্রসার করতে চাইছে কেন্দ্র, কিন্তু নেপথ্যে বিজেপির ‘এক দেশ, এক ভাষা’ চাপিয়ে দেওয়ার এজেন্ডা রয়েছে। অনেকের মতে, বিজেপির অন্যতম গোপন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বাংলা, তামিল, তেলুগু, উর্দুর উপর হিন্দির দাদাগিরি কায়েম করা। জাত্ম্যাভিমানে সুড়সুড়ি দিয়ে হিন্দিকে ইংরেজির বিকল্প হিসাবে সামনে এনে আদতে হিন্দির আগ্রাসন চালাতে চাইছে বিজেপি সরকার।
[আরও পড়ুন: ‘যে রাজ্যেরই বাসিন্দা হন, কথা বলুন হিন্দিতে’, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে বিতর্ক]
শাহ বলেছেন, “সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী দেশের সরকারি কাজের প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় হিন্দি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাই ঠিক করেছেন সরকারি কাজে সরকারি ভাষাই ব্যবহার করতে হবে। এতে অবশ্যই হিন্দির গুরুত্ব বাড়বে। সরকারি ভাষাকে দেশের সংহতি রক্ষার কাজে ব্যবহার করার সময় এসে গিয়েছে।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “যখন দু’টি ভিন্ন ভাষার সরকারি কর্মী নিজেদের মধ্যে কথা বলবেন, তাঁদের ভাষা যেন এ দেশীয় হয়, ইংরেজি নয়।”
শাহের বক্তব্যের বিরুদ্ধে সরব কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম, ডিএমকে। বাংলা থেকে কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ অভিষেক মনু সিংভি দিল্লিতে বলছেন, “হিন্দি দিয়ে পেট ভরবে তো? মুদ্রাস্ফীতি, বেকারি-সহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকে নজর ঘোরাতেই এখন হিন্দি নিয়ে পড়েছে ওরা।” কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার মত, “হিন্দি কখনই আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল না। তা হতে দেবও না।”
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, “হিন্দি ভাষাকে আমরা শ্রদ্ধা করি৷ হিন্দিভাষীদেরও শ্রদ্ধা করি৷ হিন্দি ভাষাভাষী শিল্পী, সাহিত্যিক, সাধারণ মানুষ সকলকে ভালবাসি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে আগ্রাসনের একটা ভয়ংকর ইঙ্গিত দিয়েছেন, আমরা তা সমর্থন করি না। বিরোধিতা করি। ইংরেজি ব্যবহারের বদলে উনি হিন্দি ভাষার কথা বলেছেন। আর একটি ভাষা ব্যবহার করেছেন, ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ইন্ডিয়া। আমি সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই হিন্দি কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ভাষা নয়। আমাদের কোনও রাষ্ট্র ভাষা নেই। এখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য আছে। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের ভাষা রয়েছে। আমাদের ভাষা বাংলা। কিন্তু নিশ্চিতভাবে এখানে অনেক হিন্দিভাষী আছেন। আবার শিক্ষা ও আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে যোগাযোগের কথা মাথায় রাখলে ইংরেজি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। ফলে দেশ যে সিস্টেমে চলছে তাতে নানা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। আর আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। আমরা চাই যে সিস্টেম চলছে সেটাই বজায় থাকুক। নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্যে সবাই হিন্দি বলেন বলে দেশের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হবে, বাংলার ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হবে, অসমে-ওড়িশায় হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হবে, এটা গ্রহণযোগ্য নীতি হতে পারে না। এটা সুপরিকল্পিত হিন্দি আগ্রাসনের একটা উদ্বেগজনক প্রতিফলন। হিন্দিকে যদি চাপিয়ে দেওয়া হয় আমাদের বিরোধিতা থাকছে।”
কান্নুরে পার্টি কংগ্রেসের ব্যস্ততার মধ্যে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বললেন, “মানুষ কোন ভাষায় কথা বলবে সেটাও ওরা ঠিক করে দিতে চায়। এর বিরুদ্ধে আমরা বামপন্থীরা লড়াই করছি। সমস্ত অ-বিজেপি, বাম গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট করতেই আমরা পার্টি কংগ্রেসে মিলিত হয়েছি।” স্বাভাবিক নিয়মেই ‘বস’-এর সিদ্ধান্তের হয়ে সওয়াল করেছেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। বলেন, “উনি ভুল কী বলেছেন? এই তো সদ্য নেদারল্যান্ড থেকে ফিরলাম, ওখানে বিভিন্ন ভাষার ভারতীয়দের সঙ্গে কথা হল। সবাই তো হিন্দিতেই কথা বললেন।”
একমাত্র হিন্দিই পারে গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে, ২০১৯ সালেও মন্তব্য করে দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন অমিত শাহ। সেবার দলমত নির্বিশেষে কেন্দ্রকে চাপে ফেলেছিল দক্ষিণী দলগুলি, যার জেরে ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়েছিলেন শাহরা। রাষ্ট্রীয় ভাষা প্রসঙ্গে মঙ্গলবার ঝড় উঠেছিল সংসদেও। কেন্দ্রীয় সংস্থায় বাংলা-সহ স্থানীয় ভাষায় হোর্ডিং চেয়ে সওয়াল করেন তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায়। সেই সময় চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নায়ডু ট্রেজারি বেঞ্চকে ‘আঞ্চলিক ভাষা’গুলি ব্যবহারের নির্দেশ দিতেই প্রতিবাদ করেন কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশ। বলেন, “আঞ্চলিক ভাষা বলাটা ঠিক হচ্ছে না। এগুলি প্রতিটিই রাষ্ট্রীয় ভাষা।” উল্লেখ্য, ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিল অনুযায়ী দেশে কোনও রাষ্ট্রীয় ভাষা নেই। হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু-সহ ২২টি ভাষাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।