সোমনাথ রায়, শ্রীনগর: শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্র লালচক থেকে গাড়িতে মিনিট পাঁচেক গেলেই আসে বারবার শাহের ফার্নিচার মার্কেট। বাব ডেম্ব রোডের ঠিক উপরেই গোল্ডেন ভিউ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে তার বাড়ি। পাশের সরু গলিতে ঢুকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে কাশ্মীরি পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিতির সভাপতির ঠিকানায়। কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ছোট্ট ঘরে বসে যা বললেন হাজার উপদ্রবেও উপত্যকা ছেড়ে না যাওয়া পণ্ডিত, তা শুনে মনে জাগতে পারে নানা প্রশ্ন। এই কথাগুলি কোনও কাশ্মীরি পণ্ডিতেরই তো? তাহলে কেন্দ্র যা যা দাবি করছে সেগুলি পুরোটাই ধাপ্পা? জানালেন, লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ পর্যন্ত তাঁদের সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন। এছাড়াও ৩৭০ ধারা বাতিল পরবর্তী ভূস্বর্গের হালহকিকত নিয়ে ঠিক কী কী বললেন, চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
পরিস্থিতি কেমন
পর্যটকদের জন্য ভাল ঠিক, তবে আমাদের, মানে সংখ্যালঘুদের জন্য মোটেই নয়। ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন বলবৎ হওয়ার পর দীর্ঘ ১৮ বছর বাদে আবার উপত্যকায় শুরু হল ‘টার্গেট কিলিং’। তারপর থেকেই কাশ্মীরি পণ্ডিত, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পরিস্থিতি একেবারেই আর ভাল নেই। নিরাপত্তা ছাড়া বিজেপি নেতারা ঘুরতে পারবে? গত বছর রাহুল গান্ধীজি তো কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই কাশ্মীর ঘুরে গেলেন। জে পি নাড্ডাজিকে বলুন নিরাপত্তা ছাড়া লালচকে গিয়ে দেখান। আসলে বিজেপিও জানে কাশ্মীরের পরিস্থিতি একেবারেই ভাল নয়। এ হল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। আগ্নেয়গিরিতে লাভা জমে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। যেদিন তা বেরিয়ে আসবে, কী যে হবে আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারছি না। পুরো দেশ জ্বলবে। এখানে আমরা তিন হাজার আছি, মারা যাব ঠিক আছে। ভাবুন ভারতের কী হবে?
[আরও পড়ুন: হাতে নগদ মাত্র ৫৫ হাজার, রাহুল গান্ধীর মোট সম্পত্তির পরিমাণ কত?]
উপত্যকা শান্ত
১৯৯২ থেকে শুরু করে বিজেপি বারবার কাশ্মীরি পণ্ডিতদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে।
আমার ধারণা এবারও তাই হবে। এখনও তো ওদের ইস্তাহার প্রকাশ হয়নি। দেখবেন পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের জন্য নিশ্চয়ই গালভরা অনেক কিছু থাকবে। আমরা যারা এই পরিস্থিতিতে বাস করছি, শুধু তারাই এখানকার আসল পরিস্থিতি জানি। ক’দিন আগে মোদিজির র্যালি হল। তার নানা ছবি ঘুরে বেড়াল সংবাদমাধ্যমে। তাতে কারা ছিল জানেন? সরকারি কর্মচারীদের ধমক চমক দিয়ে নিয়ে এসেছিল। ওরা বিনা নিরাপত্তায় লালচকে কোনও অনুষ্ঠান করে দেখাক, তখন বলব পরিস্থিতি ভাল হয়েছে। কাশ্মীরে যদি শান্তিই থাকবে, কেন আমাদের কাছে বারবার থানা থেকে আসা ফোনে পার্লামেন্ট রেজাল্ট বেরনো পর্যন্ত সতর্ক থাকতে বলা হবে? উপত্যকা যদি শান্তই থাকবে, কেন বিজেপি নেতাদের এত নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরতে হয়? ২০০৪ সালে লালচক থেকে প্রথমবার জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বের করেছিলাম আমি। কোনও নিরাপত্তা ছিল না তো। মনে রাখবেন, সেই সময়ে সন্ত্রাসবাদ খুব ভালরকম ছিল। আজও আছে। তবে প্রকাশ্যে নয়, লুকিয়ে। কে কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, কার পকেট থেকে পিস্তল বেরিয়ে আসবে কেউ জানে না। পাত্থরবাজি বন্ধ হয়েছে ঠিক, বদলে হাতে হাতে পিস্তল। কাশ্মীর জুড়ে যে আড়াই হাজার পিস্তল আছে, তা এল কোথা থেকে? ’৯০-তে না হয় অশান্তি ছিল। এখন তো বর্ডার সিল। কাশ্মীর জুড়ে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা। তাহলে সোমবারই সোপরে পিস্তল উদ্ধার হল কীভাবে? কিছুদিন আগে নতুন এ কে ৫৬-ম্যাগাজিন উদ্ধার হয়েছে। কোথা থেকে এল? পরিস্থিতি যদি ঠিকই থাকত, তাহলে কেন তিন দফায় লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে? কেন ১৯৩ কোম্পানি সিআরপিএফ আসছে?
হর ঘর তিরঙ্গা
ছাড়ুন তো। কাশ্মীরে তিরঙ্গা আগেও ছিল, এখনও আছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, স্বাধীনতা দিবসে বক্সি স্টেডিয়াম ভর্তি থাকত। দল বেঁধে হাতে পতাকা নিয়ে সেখানে যেতাম। গণতান্ত্রিক দিবসের সময় স্কুলে শীতের ছুটি থাকত বলে যেতে পারতাম না। শেষ স্বাধীনতা দিবসে বক্সি স্টেডিয়ামে জনসমাগম কত ছিল?
কোন পথে
দেশের চারিদিক জুড়ে শুধুই আমিত্ব। দেশ আমি নয়, আমাদের মাধ্যমে চলে। কাশ্মীরের সমস্যা সমাধান করতে মাতৃত্বসুলভ আচরণ করতে হবে। পাঁচ সন্তানকে মা একরকম ভাবে মানুষ করে না। প্রত্যেককে তাদের মতো করে বড় করে। সবসময় যদি লাঠি নিয়ে ঘোরা হয়, তবে সেই বাচ্চা বড় হয়ে আগে নিজের মাকেই মারবে। কয়েক বছর আগে ডাউনটাউনে তিন সন্ত্রাসবাদী ভাই নিজেদের মাকে গুলি করে মারে। ওদের মাথায় জেহাদের ভূত ছিল। ঠিক একইরকম ভূত আজকের কিছু নেতাদের মধ্যেও আছে। হিন্দুত্ব কী, সেটা ওরা এখনও জেনে উঠতেই পারেনি। যে একরোখা মনোভাব আমাদের দেশের কয়েকজন নেতার মধ্যে রয়েছে, তা বাদ না দিলে কিছুতেই কিছু হবে না। রাজনাথ সিং যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, ওঁর মধ্যে এই নম্রতা ছিল। যেটা অমিত শাহর মধ্যে একেবারেই নেই।
[আরও পড়ুন: ‘দেশকে বাঁচাবে ইন্ডিয়া’, চিরাগের দল ছেড়ে বিরোধী জোটে ২২ নেতা, বিহারে বিপাকে এনডিএ]
রাম ফাইলস
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গল্প দেখাতে হলে কে পি ফাইলস নাম দিতে পারত। এটা কাশ্মীরকে বদনাম করার চক্রান্ত। ওই সময় শুধু পণ্ডিতরাই ভোগেনি, অনেকে ভুগেছে। এটা ঠিক, আমরা প্রথম আক্রান্ত। তার মানে এই নয়, মুসলমানরা আক্রান্ত হয়নি। শুধু রামমন্দির করলেই হবে না। তার সঙ্গে রামের জীবন মেনে কাজ করতে হবে। রাম কখনও কারও সঙ্গে বৈষম্য করেনি। সবথেকে বড় কথা ওরা তো রামের অপমান করে। রাম কথাটাই তো পূর্ণ নয়। ঠিক যেমন শক্তি ছাড়া শিব অপূর্ণ, তেমনই সীতা ছাড়া রাম। তাই রামকে অপমান না করে জয় সিয়ারাম বলুন। মর্যাদা পুরুষোত্তমের দেখানো পথে চলুন। সবাই যে যার নিজের ধর্ম নিয়ে থাকবে, দেশ শান্তিতে প্রগতি করবে।