বিনিয়োগ-ব্যবসা-স্টক মার্কেট-মিউচুয়াল ফান্ড-সবই বড় ‘সিরিয়াস’ ব্যাপার-স্যাপার। গম্ভীর, জটিল গোত্রের। কিন্তু সত্যিই কি তাই? উত্তর ‘না’। একেবারেই না। যতই ঝুঁকির কুয়াশা ঘিরে থাকুক, যতই দামের ওঠাপড়ায় অনিশ্চয়তা তৈরি হোক, লগ্নির ফর্মূলা শুধুমাত্র এইটুকু গণ্ডির মধ্যে সীমিত থাকে না। নিয়ম হল, বিনিয়োগকে বিনিয়োগকারীর ‘ইমোশনাল প্রোফাইল’-এর সঙ্গেও সাযুজ্য রাখতে হবে। ভুললে চলবে না, স্টক মার্কেটে ‘ইমোশনাল ট্রিগার’ও অত্যন্ত জরুরি। ‘সঞ্চয়’-এর জন্য বিশেষ এই লেখায় জানালেন সৌমিত্র সেনগুপ্ত
সাধারণ বিনিয়োগকারী হিসাবে আমরা প্রথমেই শেয়ার মার্কেটে দামের ওঠাপড়া, বা ইনডেক্সের বাড়বৃদ্ধি, দেখতে অভ্যস্ত। তবে ইকুইটিতে লগ্নি করার অর্থ কেবলমাত্র সঠিক স্টকগুলি বেছে নেওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। ফাইন্যান্সিয়াল ডেটা নিরীক্ষণ করলেন, সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যাচাই করলেন, এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলির লাভ-ক্ষতির বিচার করলেন – না, মার্কেটে লগ্নি করা শুধু এতেই সীমিত রাখার কথা নয়। বিনিয়োগ যেন আপনার ‘ইমোশনাল প্রোফাইল’-এর সঙ্গে মিলে যায়। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ কথা জানাচ্ছি- পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যেমন দরকার, ইমোশনাল প্রোফাইল অনুযায়ী স্টকগুলির সঙ্গে একাত্মবোধ তেমনই প্রয়োজনীয়।
এ কথা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, ইমোশনাল ‘ট্রিগার’ (যেমন বন্দুকের ট্রিগার হয়ে থাকে)- স্টক মার্কেটে এক ভীষণ জরুরি একটি শর্ত। আমরা ‘রিস্ক’ বা ঝুঁকি নিয়ে নানা রকম চিন্তাভাবনা করেই থাকি। ‘ফিজিক্যাল রিস্ক’ নিয়ে আমরা সবিশেষ চিন্তিত – সেই ঝুঁকিগুলি কীভাবে আমাদের লগ্নির উপর ছাপ ফেলবে তা জানতে আমরা সবাই উদগ্রীব।
[আরও পড়ুন: ‘বাল ভবিষ্য যোজনা’, শিশুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে বেছে নিন এই ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান]
এখানে যে থিয়োরিটির উল্লেখ আমি করব, তা হল ‘প্রসপেক্ট থিয়োরি’- দুই ইজরায়েলি মনস্তত্ববিদ এটিকে জনপ্রিয় করেছেন। অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ কীভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। স্টক মার্কেটে প্রভূত পরিমাণে অনিশ্চয়তা আছে, এবং সেই সঙ্গে ভয়-ভীতি ইত্যাদিও জড়িয়ে থাকার ফলে সিদ্ধান্তগুলি সর্বদা সঠিক হয় না।
মনে করুন, আপনার সামনে দুটি পথ খোলা। প্রথম, আপনি এক লক্ষ টাকা লাভ করবেনই, যা-ই হোক না কেন। দ্বিতীয়, আপনি তিন লক্ষ টাকা লাভ করতে পারেন যদি একটি কয়েন টস করে ঠিক ‘কল’ নিতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে প্রথমটির দিকেই মানুষ ঝুঁকছেন। এবার পুরো পরীক্ষাটি উল্টে দেওয়া যাক–
নতুন পরীক্ষায় প্রথম দৃশ্যে আপনার এক লক্ষ ‘লস’ হবেই। আর দ্বিতীয় দৃশ্যে ‘লস’ হতে পারে তিন লক্ষ। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ ‘প্রোবাবল লার্জার লস’ তথা সম্ভাব্য বৃহত্তর ক্ষতি বেছে নিচ্ছেন। তুলনায় কম (কিন্তু ১০০ ভাগ নিশ্চিত/যথার্থ) ক্ষতির দৃশ্য আর ধর্তব্যের মধ্যে আসছে না।
সংক্ষেপে এই হচ্ছে স্টক মার্কেটের সার্বিক পরিস্থিতির নির্যাস। সুরক্ষা এবং নিশ্চয়তা পাওয়ার আশায়, বিনিয়োগকারীরা অনেক সময়ই সম্ভাব্য ‘লস’ মেনে নেন। ‘লস অ্যাভারশন’ (Loss Aversion) আমরা একেই বলে থাকি।
উল্লেখ্য, ‘প্রসপেক্ট থিয়োরি’র উদ্ভাবকদ্বয়ের অবদান আজও সম্মানের সঙ্গে চর্চিত। তাঁদের নাম? অ্যামোস টারস্কি এবং ড্যানিয়েল কাহনেমান। আরও তথ্য চাইলে ২০০২ সালের নোবেল পুরস্কার নিয়ে একটু পড়াশোনা করে নিন।
(লেখক ডিরেক্টর, ল্যামরন অ্যানালিস্টস)