shono
Advertisement

ক্রিপ্টোকারেন্সি: সোনার খনি না কি সীমাহীন ঝুঁকির দুনিয়া?

বিটকয়েনের এক একটির এখনকার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা।
Posted: 02:05 PM Dec 10, 2021Updated: 02:05 PM Dec 10, 2021

বাজারে কান পাতুন, একটাই শব্দ শুনবেন ঘুরেফিরে। হ্যাঁ, ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’-র কথাই বলছি। এটি হল এমন একটি ডিজিটাল ‘কারেন্সি’ তথা মুদ্রা, যা কোনও সরকার বা রাষ্ট্র তৈরি করে না, সরবরাহ-ও করে না। তবে একে নিজের সম্পত্তি হিসাবেই ব্যবহার করা যায়, এর জন্য কোনও ব্যাংক বা এটিএম নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ নিয়ে চাহিদা এখন তুঙ্গে। কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত এই নিয়ে বিলও পেশ করতে চলেছে। কিন্তু ঠিক কতটা নিরাপদ এই ‘কারেন্সি’? লাভের দিক থেকে বিচার করলে কত নম্বর পাবে এটি? সম্ভাবনার ‘লেটার মার্কস’ না ঝুঁকির ‘জিরো’? ‘সঞ্চয়’-এর জন্য বিশেষ এই লেখায় জানালেন অরিন্দম সাহা

Advertisement

 

ক্রিপ্টোকারেন্সি’-এক ধরনের ম্যাজিকই বটে। কেমন করে পাবেন তাকে? কোথাও চাকরি করতে হবে না। পৈতৃক সম্পত্তিরও প্রয়োজন নেই। এমনকী লটারি না কাটলেও চলবে। শুধু বেশ খানিকটা প্রোগ্রামিং জানতে হবে। ব্লকচেন টেকনোলজি ব্যবহার করে অতি দ্রুত তৈরি করে নিতে পারেন অধুনা বহুচর্চিত ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’। ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই। এর পরের ধাপ হল, কিছু সংখ্যক গ্রাহক সংগ্রহ করা। তাঁরা আপনার ভরসায় আপনার বানানো ডিজিটাল কয়েন কিনবেন। তবে কয়েন কিন্তু সীমিত সংখ্যকই থাকবে।

ধরুন আপনি ১ লক্ষ কয়েন বানালেন। তার একটা শুরুর দাম ধার্য করলেন। প্রতি কয়েন ১০ টাকা। তাহলে মোট মূল্য দাঁড়াল ১০ লক্ষ টাকা। এবার তৃতীয় পর্যায়। শুরু করলেন প্রচার। কিছু পণ্যবিক্রেতা রাজি হলেন, আপনার তৈরি করা কয়েনের বিনিময়ে ব্যবসা করতে। কেন? তার একটা উত্তর প্রচারের আলো। কারণ ততক্ষণে আরও বেশ কিছু লোক ওই কয়েন গ্রহণ করেছে। ফলে পণ্যবিক্রেতা মনে করতেই পারেন, এই কয়েনের ব্যবহার তাঁর ব্যবসার পরিসর বাড়িয়ে তুলবে। দ্বিতীয় কারণ, বিনিয়োগ থেকে আয়। ঠিক যে কারণে আপনি আফগানিস্তানের বা পাকিস্তানের মুদ্রার তুলনায় ডলার কেনা বেশি পছন্দ করবেন। কারণ আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন ডলারের দাম অন্যান্য মুদ্রার থেকে বাড়বে। এখানেই কয়েন প্রস্তুতকারকের, আর শুরুর দিকে যাঁরা তা কিনেছিলেন, তাঁদের পোয়াবারো। কারণ কয়েনের সংখ্যা যে সীমিত! অথচ চাহিদা বাড়ছে। ফলে দামও বাড়ছে। যে সর্বশেষে কয়েন পাচ্ছে সে ভাবছে আরও দাম বাড়বে। অতএব আরও গ্রাহক বাড়বে।

[আরও পড়ুন: ‘বাল ভবিষ্য যোজনা’, শিশুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে বেছে নিন এই ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান]

এখানে আরও একটা ব্যাপার আছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রস্তুতকারকরা ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং’ বলে একটি পদ্ধতির অনুমতি দেন। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে হাত বদলের সময় এক ধরনের ‘চেকিং’ হয়। অনেক প্রোগ্র্যামারই এতে অংশ নেন। তাঁরা যে জটিল পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যান, তা সফল হলে একটা মূল্য পান-যা অধিকাংশ সময় কয়েন দিয়ে মেটানো হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে নতুন কয়েনের মালিকানা তৈরি হয়।

এতক্ষণ যা বোঝানোর চেষ্টা করলাম তা বেশ জটিল প্রক্রিয়া এবং যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণও বটে। এর প্রধান কারণ, এর মধ্যে সরকারি সিলমোহর নেই। সাধারণত সরকার থেকে যে মুদ্রা তৈরি হয় ও বাজারে ছাড়া হয়, তা কোনও নির্দিষ্ট জমা থাকা সম্পদের যোগফলের মূল্যের ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি পুরোটাই কারও মস্তিষ্কপ্রসূত প্রোগ্র্যামের ওপর নির্ভর করে, নির্দিষ্ট পণ্যভিত্তি বা কোনও বিনিময়মূল্য ছাড়াই। তাই একে আদৌ ‘কারেন্সি’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির আকর্ষণটা হয়তো অন্য জায়গায়। এর গোপনীয়তা পদ্ধতি ঈর্ষণীয়। এক সময় সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার মালিকের নাম জানা যেত না। ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিকের নামও আজ গোপন থাকে। আর যেখানেই গোপনীয়তা, সেখানেই করের হিসাব রাখা দুষ্কর। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হল, কেউ কয়েন দিয়ে কী লেনদেন করছে, তা জানা প্রায় অসম্ভব। এত গোপনীয়তার একটা অবশম্ভাবী পরিণাম হল, কয়েন হারিয়ে যাওয়া। আসলে এই কয়েন থাকে ডিজিটাল লকারে। কেউ পাসওয়ার্ড ভুললেই বিপদ! সব শেষ! চিরকালের মতো কয়েন হারিয়ে যাবে। এইভাবে প্রচুর কয়েন হারিয়ে যায়। এটাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কয়েনের দাম বাড়ার একটা অন্যতম কারণ। সবসময় মনে রাখবেন, এই কয়েনের সংখ্যা কিন্তু সীমিত।

আজ পর্যন্ত প্রচুর কয়েন তৈরি হয়েছে। সংখ্যাটা প্রায় ৫ হাজারের কাছাকাছি বা তারও বেশি। সরকারি নজরদারির বাইরে চলতে থাকা এই সব কয়েনকে প্রচুর সংস্থা, তাদের জিনিসপত্র কেনা বেচার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়। অনেক দেশ বা সংস্থা একে মানে না। তার একটা কারণ কয়েনের দামের (গুরুত্বেরও) ভয়ঙ্কর ওঠানামা। অন্যতম জনপ্রিয় কয়েন বিটকয়েনের এক একটির এখনকার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। মাত্র বছর দশেকের মধ্যে এই কয়েনের দাম কয়েকশো গুণ বেড়েছে। সাতোশি নাকামোতো (যিনি আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেননি) আবিষ্কৃত ক্রিপ্টোকারেন্সি পদ্ধতির এই মুদ্রা মোট ক্রিপ্টোকারেন্সির ৪০-৫০ শতাংশ। মনে করা হয় এখনও পর্যন্ত প্রায় ২৫ লক্ষ বিটকয়েন হারিয়ে গিয়েছে। ২০১৭ সালের হিসেবে যার মূল্য ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই লেখা যখন লিখছি, তখন ক্রিপ্টোকারেন্সির দর কমবেশি প্রতিদিন ২০ শতাংশ ওঠানামা করার নজিরও তৈরি হয়েছে। দামের এই ওঠানামাই অনেকের কাছে ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল আকর্ষণ।

বিটকয়েনের মতো প্রচুর বেসরকারি কয়েন আছে। যেমন, ইথারিয়াম, এক্সআরপি, ট্রন, ডোজ, লাইট কয়েন, ইউএসডিটি, ড্যাশ কয়েন ইত্যাদি। মোটামুটি ২ থেকে ৫ কোটি টাকা থাকলেই বানিয়ে ফেলা যায় পছন্দের নামের ক্রিপ্টোকারেন্সি। তবে সেটি জনপ্রিয় হয়ে পরে লক্ষীলাভ করবে কি না তা অবশ্য অন্য বিষয়।

ক্রেতা-বিক্রেতা ব্যতীত কোনও ধরনের তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বাদ দিয়ে আজ ক্রিপ্টোকারেন্সি কিছু মানুষের কাছে খুবই আকর্ষণীয়, বিশেষত যাঁরা ঝুঁকি নিতে পারেন। যে কেউ তাঁর পরিচয় গোপন রেখে অনেকটা সাধারণ মুদ্রার মতোই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করতে পারবেন। ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেট খুলতে ব্যবহারকারীর নাম, ঠিকানা, প্যান-আধার ইত্যাদি তথ্যের দরকার হয় না। ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির ওয়ালেটে ‘ট্রান্সফার’ হয়, মাঝখানে কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকে না। ফলে বিনিয়োগ বা লেনদেনের সম্পূর্ণ ভাগীদার সেই ব্যক্তি নিজেই। ঠিক একই কারণে, বিপদে পড়লেও আবার নিজেকেই সামলাতে হবে। আরও স্পষ্টভাবে বললে, অজানা কোনও বিপদ এলে তা সামলানোর জন্য কোনও ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর বা সরকারি সংস্থার দায়বদ্ধতা থাকার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।

(লেখক ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ভিস্তা ইন্টালিজেন্স)

[আরও পড়ুন: সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার সহজ উপায় টার্ম পলিসি, জেনে নিন খুঁটিনাটি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement