উপার্জনের অঙ্ক বাড়বে, লাভের হার চড়বে–দিনের শেষে প্রত্যেক লগ্নিকারীর উদ্দেশ্য তো এটাই! কিন্তু বিনিয়োগ করতে নেমে আগে থেকে ঝুঁকির মূল্যায়ন না করলে বা সেই মতো পদক্ষেপ না করলে, সেই উদ্দেশ্য পূরণ অসার্থকও হতে পারে। কাজেই ইনভেস্টমেন্ট করার আগে সব দিক, সমান গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করে তবেই এগোন। ‘সঞ্চয়’-এর জন্য বিশেষ এই দুই কিস্তির লেখায় এমনই পরামর্শ সাজিয়ে দিলেন এমিনেন্ট কলেজ অফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক ডঃ সৌরভ মজুমদার।
আমরা সকলেই আমাদের আয়ের উদ্বৃত্ত অর্থ বিনিয়োগ করি। বিনিয়োগ করি ব্যাঙ্ক, ফিক্সড ডিপোজিট, মিউচুয়াল ফান্ড, কোম্পানির শেয়ার, ধাতু যেমন সোনা-রূপা বা অন্যান্য ফিনান্সিয়াল অ্যাসেটে এবং আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য, অতিরিক্ত আয়। অতিরিক্ত বলার কারণ এই আয় যেন অবশ্যই মুদ্রাস্ফীতিকে ছাপিয়ে যায়। কারণ আয় যদি মুদ্রাস্ফীতির থেকে কম হয় তবে বিনিয়োগকারীর প্রকৃত আয় অবশ্যই কম হয়। অতএব আমরা বলতে পারি,
প্রকৃত আয় =
বিনিয়োগের আয় - মুদ্রাস্ফীতির হার
এবার দেখা যাক, এই বিভিন্ন রকমের বিনিয়োগের উপায়গুলো নিয়ে। যে বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্ক ফিক্সড ডিপোজিটে বা বন্ড ফান্ডে বিনিয়োগ করছেন অবশ্যই তাঁর রিটার্নজনিত প্রত্যাশা কম হবে। এবং যে বিনিয়োগকারী কোম্পানি শেয়ার বা ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁর রিটার্নজনিত প্রত্যাশা বেশি হবে। তাহলে, এ প্রশ্ন জাগে যে ফিনান্সিয়াল অ্যাসেটে প্রকৃত আয়ের সম্ভাবনা কম, সেখানে বিনিয়োগকারী টাকা রাখবেন কেন? এখানেই আসে ঝুঁকির প্রশ্ন। অর্থাৎ যে বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কম, তিনি ব্যাঙ্ক এফডি, বন্ড ফান্ডের দিকে ঝুঁকবেন, প্রকৃত আয় কম হওয়া সত্ত্বেও। এবং যে বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বেশি, তিনি শেয়ার এবং ইক্যুইটি এমএফ-এ বিনিয়োগ করবেন বেশি আয়ের আশায়। অর্থাৎ আয় এবং ঝুঁকির মধ্যে একটি সরলীকরণ আমরা করতে পারি যে, আয় এবং ঝুঁকি সমানুপাতিক।
[আরও পড়ুন: চড়া ডিভিডেন্ডে ইনভেস্টরদের স্বস্তি, লগ্নির আগে বিশদে জেনে নিন]
কিন্তু ঝুঁকি কী? তার কি কোনও সংজ্ঞা আছে? বা বিনিয়োগের আয় যেমন আমরা গাণিতিক রূপে প্রকাশ করতে পারি, ঝুঁকি কি কোনও সংখ্যা দিয়ে নির্দেশ করা যায়? অবশ্যই যায়। তবে প্রথমে আমরা আর্থিক ঝুঁকির একটি সংজ্ঞা বোঝার চেষ্টা করি। একজন বিনিয়োগকারীর আর্থিক ঝুঁকি বা ফিনান্সিয়াল রিস্ক বিনিয়োগকারীর প্রকৃত আয় এবং তাঁর প্রত্যাশিত আয়ের ব্যবধানের সম্ভাবনা। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। ধরা যাক, একজন বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্ক এফডি-তে বিনিয়োগ করছেন ৭% হারে। এখানে তাঁর ঝুঁকি খুব কম, কারণ এর বিনিয়োগে ৭% রিটার্ন আশা করবেন এবং সেটাই পাবেন। সুতরাং প্রকৃত আয় এবং তাঁর প্রত্যাশিত আয়ের ব্যবধান প্রায় শূন্য। সুতরাং ঝুঁকি খুব কম। পক্ষান্তরে যে বিনিয়োগকারী শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন, তাঁর এই ব্যবধানের সম্ভাবনা খুব বেশি। সুতরাং ঝুঁকি বেশি। এই ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কিন্তু বিভিন্ন মানুষের মধ্যে এক এক রকম। নানা রকম ঝুঁকি নেওয়ায় প্রবণতার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল অ্যাসেটের সৃষ্টি।
এই ঝুঁকি বা ফিনান্সিয়াল রিস্ক প্রধানত দুপ্রকারের। সিস্টেম্যাটিক রিস্ক এবং আন-সিস্টেম্যাটিক রিস্ক। প্রত্যেক কোম্পানিকে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অনেক রকম ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে কিছু কারণ থাকে যা সকল কোম্পানিকেই প্রভাবিত করে। যেমন মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দা, সুদের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি। এই ধরনের রিস্ককে বলা হয় সিস্টেম্যাটিক রিস্ক। পরিবর্তে কিছু ব্যবসায়িক ঝুঁকি থাকে যা কি না কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানিকেই প্রভাবিত করে। একে বলা হয় আন-িসস্টেম্যাটিক রিস্ক। উদাহরণস্বরূপ কোনও কোম্পানির শ্রমিক অসন্তোষ বা অন্য কোনও কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, কোনও কোম্পানির তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া বা কোনও কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনও আইনি প্রক্রিয়া চলা ইত্যাদি।
[আরও পড়ুন: লগ্নির কী-কেন-কত মাপুন ক্যালকুলেটরের সাহায্যে, জেনে নিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ]
অর্থাৎ, এই দুটি রিস্কই কোনও কোম্পানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান। কিন্তু কোনও বিনিয়োগকারী যদি তাঁর সকল বিনিয়োগযোগ্য অর্থ একটি শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, তবে তিনি সিস্টেম্যাটিক রিস্ক এবং আন-সিস্টেম্যাটিক রিস্ক, এই দুইয়েরই সম্মুখীন হবেন। এর পরিবর্তে তিনি যদি তাঁর একই বিনিয়োগযোগ্য অর্থ একের বেশি শেয়ারে বিনিয়োগ করেন তবে আন-সিস্টেম্যাটিক বা কোম্পানি স্পেসিফিক রিস্ক হ্রাস পাবে। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, বিনিয়োগযোগ্য অর্থ একটি পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ করা অবশ্যই কম ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা নিচের রেখাচিত্র থেকে এই বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব।
গবেষকরা বলেছেন যে, একটি পোর্টফোলিওতে ২০-৩০টি শেয়ার থাকলে আন-সিস্টেম্যাটিক রিস্ক অনেকটাই কমিয়ে ফেলা যায়। অতএব বিনিয়োগযোগ্য অর্থ কেবলমাত্র একটি শেয়ারে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। বিনিয়োগের পরিভাষায় এই দুই রিস্কের যোগফলকে বলা হয় টোটাল রিস্ক। যাকে গাণিতিক ভাষায় σ (Sigma) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। সিগমা বা টোটাল রিস্ক একটি পরিসংখ্যান এবং গাণিতিক পরিভাষায় এর নাম স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন।