বাজার অর্থনীতির গতিপথ আগামিদিনে কোন খাতে এগোবে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত সব বিশেষজ্ঞরাই। তবে জানা যাচ্ছে, মার্কিন ‘ঝুঁকি’ এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসাবে অবতীর্ণ হতে পারে। এমনকী, বিশ্বের সামগ্রিক জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য বলেই দাবি। বিস্তারিত জানালেন কর্পোরেট ট্রেনার (ফিনান্সিয়াল মার্কেটস) জয়দীপ সেন
ইক্যুইটি মার্কেট তো এত চড়ে গিয়েছে, এবার নিশ্চয়ই একটা কারেকশন আসবে, তাই না? এমন প্রশ্ন আমাদের অহরহ শুনতে হচ্ছে বেশ কিছু কাল ধরেই। হ্যাঁ, বাজারে চড়া ভ্যালুয়েশন নিয়ে সবাই জানতে চান, এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিকও নয়, কারণ স্টকের দাম সম্বন্ধে অনেকেই কৌতূহলী। আবার উলটোদিকে, আর এক শ্রেণির বিনিয়োগকারীর মনে এত প্রশ্ন নেই, এ-ও লক্ষ্য করেছি। দুপক্ষের আলোচকরা নিজেদের স্বপক্ষে যুক্তি দেখান, বলেন তাঁদের চিন্তাটাই সঠিক।
তাহলে সংক্ষেপে বলতে হলে, আজ আমাদের সামনে দুটো স্বতন্ত্র ধারণা।
ক) ভ্যালুয়েশনের বিভিন্ন মেট্রিক অনুযায়ী আমাদের স্টক মার্কেট যথেষ্ট ‘স্ট্রেচড’ বা চড়া।
খ) এত সব স্বত্ত্বেও, একগুচ্ছ ইতিবাচক শর্তের ভিত্তিতে বলা যায় যে–না, এখনও দৌড় বাকি, আরও কিছু দেখার অপেক্ষায় থাকা উচিত।
দ্বিতীয় পন্থায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের যুক্তিগুলো সাজানো যাক–
১. আমাদের জিডিপি গ্রোথ এখন বেশ তেজি, খুবই সম্ভাবনাময় বলে গণ্য।
২. ডেট এবং আর্নিংস দেখলে, কর্পোরেট সেক্টর যে মোটের উপর মজবুত, তা অনেকভাবে বোঝা যায়।
৩. রেকর্ড সংখ্যক নতুন ইনভেস্টররা দলে দলে বাজারে ঢুকছেন, হয় সরাসরি নতুবা মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে।
এবার আসি আমার লেখার মূল বক্তব্যে। রিস্ক নিয়ে নির্দিষ্টভাবে আজ বলছি, বিশেষ করে মার্কিন দেশে উদ্ভূত রিস্ক নিয়ে আপনাদের জানাতে চাই। তবে তার আগে একটি বিশেষ মাপকাঠি মার্কেট ক্যাপ টু জিডিপি রেশিও। ‘সঞ্চয়’-এর পাঠকরা জানেন মার্কেট ক্যাপ কী। তবুও মনে করিয়ে দিই, নির্দিষ্ট কোনও স্টকের মার্কেট প্রাইস যদি সেটির আউটস্ট্যান্ডিং শেয়ারের সংখ্যা দিয়ে গুণ করেন, তাহলে সেটির মার্কেট ক্যাপ জানতে পারবেন। উদাহরণ দিই, বুঝতে সুবিধা হবে। এমআরএফ লিমিটেড স্টকটির মার্কেট প্রাইস ১,৪১,০০০ টাকা। তার মানে এমআরএফ দেশের সর্বাধিক দামী স্টক দামের নিরিখে। তবে তা ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল’ কিন্তু নয়। কারণ এমআরএফ-এর মোট মার্কেট ক্যাপ আনুমানিক ৫৭,০০০ কোটি টাকা (জুন ২০২৪)। তার তুলনায় রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ দেখুন। ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল’ বলতে যা বোঝায়, তাই। গত জুন মাসে রিলায়েন্সের মার্কেট ক্যাপ ছিল ১৯.৫ লক্ষ কোটি টাকা।
তার মানে আমি সমগ্র মার্কেট ক্যাপ নিয়ে বলছি। এর সঙ্গে জড়িত আছে মার্কেট ট্যাপ টু জিডিপি রেশিওটি। এরই নিরিখে বোঝা উচিত আমাদের বাজারের মার্কেট ক্যাপ কি আদৌ আকর্ষণীয় (এখনও) না কি অন্য রকম। স্পষ্টভাবে বলা যেতে পারে যে, আমরা এই মুহূর্তে ‘ওভারভ্যালুড’। সাধারণভাবে বলা চলে যে, মার্কেট ক্যাপ যদি জিডিপির সমান সমান হয়, তাহলে ‘ফেয়ারলি ভ্যালুড’ পরিস্থিতি। আর যদি তার কম হয়, তাহলে আকর্ষণীয় আর তারও বেশি হলে ‘স্ট্রেচড’। এই সন্ধিক্ষণে ভারতীয় বাজারের ক্ষেত্রে মার্কেট ক্যাপ আমাদের জিডিপির প্রায় ১৪০ শতাংশ।
বস্তুত, মার্কিন বাজারের এমন ওভারভ্যালু়ড অবস্থা চলছে। বিশ্বের সামগ্রিক জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ভূমিকা খুবই বড় মাপের। তার মানে, হ্যাঁ, আমেরিকান মার্কেট ‘ফ্রথ’ (ফেনা অর্থে, যে শব্দটি ইদানিং বাজারে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে) আছে এবং সেই অবস্থা নিয়ে আমাদের সকলেরই সম্যক ধারণা থাকা দরকার বলে আমি মনে করি। সংক্ষেপে বলতে গেলে যদি আমেরিকান মার্কেটে কারেকশন আসে, ভারতীয় বাজারেও তার অভিঘাত বুঝতে পারব আমরা।
ইতিহাস ঘাঁটুন। দেখবেন জাপানি মার্কেটের মূল সূচক নিক্কেই সব থেকে চড়েছিল ১৯৮৯ নাগাদ, যখন সে দেশের অর্থনীতিতে জোয়ার এসেছিল। তখন জাপানের অগ্রণী ভূমিকা ছিল সারা বিশ্বের জিডিপিতে। জাপানের অংশ কিন্তু প্রবলভাবে ছিল গ্লোবাল মার্কেট ক্যাপে। যখন বাজার পড়ল, তাদের প্রায় ৩৫ বছর সময় লাগল সেই ১৯৮৯ সালের পরিস্থিতিতে ফের পৌঁছতে। আজ আমেরিকাকে দেখুন–গ্লোবাল জিডিপির ২৬ শতাংশ, কিন্তু গ্লোবাল মার্কেট ক্যাপের ৫২ শতাংশ। তার মানে বিশ্বের জিডিপির এক চতুর্থাংশ নিয়েও আমেরিকার মার্কেট ক্যাপের আয়তন বিশাল। সারাংশ হিসাবে বলি, মার্কিন বাজারে কারেকশন এলে তার ‘ইমপ্যাক্ট’ ভারতেও বোঝা যাবে।