দেশের দূরবর্তী এক স্থানে কেন্দ্রের প্রশাসক কর্তৃক একতরফাভাবে ঘোষিত নতুন বিধি-বিধান চাপিয়ে দেওয়ার ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ‘গেরুয়া অ্যাজেন্ডা’-র আতঙ্ক ছড়িয়েছে।লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
শেষ যখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ছোট্ট লাক্ষাদ্বীপ জাতীয় শিরোনামে এসেছিল, তখন এদেশে সর্বক্ষণ সক্রিয় বেসরকারি খবরের চ্যানেলগুলির কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ১৯৮৯ সালের কথা- লাক্ষাদ্বীপে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী গিয়েছিলেন নতুন বছর উপলক্ষে ছুটি কাটাতে। আর এই নিয়ে বাধে এক শোরগোল- জনসাধারণের অর্থ কি এবার ‘ব্যক্তিগত’ পরিবারিক ছুটিতে খরচ করা হচ্ছে? ভালই চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল এই প্রশ্ন। কিন্তু এইবার লাক্ষাদ্বীপ জাতীয় শিরোনামে এসেছে অনেক বড় কারণে: দেশের দূরবর্তী এক স্থানে কেন্দ্রের প্রশাসক কর্তৃক একতরফাভাবে ঘোষিত নতুন বিধি-বিধান চাপিয়ে দেওয়ার ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ‘গেরুয়া অ্যাজেন্ডা’-র আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
[আরও পড়ুন: কোণঠাসা হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের জাগরণ চাইছে বিজেপি?]
প্রশাসক প্রফুল্ল খোডা প্যাটেল গুজরাতের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় খবরে ব্যাপারটায় বিশেষ রাজনৈতিক মোড়ক লেগেছে। প্যাটেল এতদিন ধরে খবরে চর্চিত হয়ে আসছেন বিভিন্ন কু-কারণে। যেমন, দাদরা ও নগর হাভেলি-র দীর্ঘকালীন সাংসদ মোহন দেলকারের আত্মহত্যার তদন্তে তাঁর নাম উঠে এসেছিল। অভিযোগ: প্যাটেল ছিলেন দেলকারের আত্মহত্যায় প্ররোচক, সে-সময় তিনি এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির প্রশাসকও ছিলেন। কিন্তু এই আত্মহত্যা সেই সময় সংবাদমাধ্যমে কোনও প্রচারই পায়নি, যেখানে সুশান্ত সিংয়ের আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যম বিরতিহীনভাবে প্রচার করে গিয়েছে। জানিয়ে রাখি, দেলকারের আত্মহত্যার তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থাও মুম্বইতে উড়ে আসেনি।
যা হোক, বিষয় হল- আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের সঙ্গমে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জ কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। প্রায় শতভাগ মুসলিম জনসংখ্যার কারণে সাংস্কৃতিক ‘উপনিবেশীকরণ’-এর চেষ্টা ও তজ্জনিত উদ্বেগও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তারপরে, জমির নতুন নিয়ম, মদ্যপানের জন্য মুসলিম অধ্যুষিত দ্বীপাঞ্চল উন্মুক্ত করে দেওয়া (যা ওখানে নিষিদ্ধ ছিল ধর্মীয় সংস্কারগত কারণে) বা গো-মাংসের বিক্রি সীমাবদ্ধ করা- প্রতিটি ব্যাপারেই সেখানকার ‘জাতীয়তাবাদী’ হিন্দুত্ববাদ বনাম আঞ্চলিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বন্দ্ব তৈরি করা হয়েছে। যা, শান্ত, ছবির মতো সুন্দর এক জায়গা, যেখানে অপরাধের হার নগণ্য, সেখানকার ৬৫,০০০ বাসিন্দাকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যদি না এক আচ্ছন্নকারী কেন্দ্রীয়করণের মানসিকতা তৈরি হয়ে থাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের, যা দেশের প্রতিটি বৈচিত্রপূর্ণ অংশে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মত ও আদর্শকে চাপিয়ে দিতে উদ্যোগী, তাহলে দেশের একপ্রান্তে পড়ে থাকা এই ছোট্ট, প্রশান্ত এক অংশকে কেনই বা বিচ্ছিন্ন ও অস্থির করে তোলা হবে, বলতে পারেন?
আদপে, এটা তখন আর কেবলমাত্র দিল্লি এবং দূরবর্তী কাভারত্তির মধ্যেকার সংঘর্ষ হয়ে থাকে না। বিতর্কটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রভাবশালী কেন্দ্র এবং দেশজুড়ে প্রতিরোধী রাজ্য সরকারগুলির মধ্যেকার গভীর সংকট। খুব কমই এমন সপ্তাহ কাটছে, যেখানে দেশের কোনও না কোনও কোণে কেন্দ্র-রাজ্যের দ্বন্দ্ব ফেটে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না। কখনও পণ্য ও পরিষেবাদি শুল্কের অধীনে সম্পদ বিতরণে বিরোধী রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা আপত্তি করছেন, কখনও বিতর্কিত কৃষি আইনগুলি কোনও তদারকি বা পরামর্শ ছাড়াই সংসদে পাস হয়ে যাচ্ছে, কখনও অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে বাদানুবাদ, বা ভ্যাকসিন পলিসি প্রয়োগের ক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া- কেন্দ্রের মোদি সরকার এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা চাপ স্পষ্টত দৃশ্যমান। এই দ্বন্দ্ব ‘সমবায় মৈত্রীতন্ত্র’-র লক্ষ্যকে বিচ্যুত করার সম্ভাবনায় বলীয়ান। কিন্তু সাত বছর আগে ক্ষমতায় এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রকেই আরও সুদৃঢ় করার সংকল্প নিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির প্রতি অনাস্থা এবং সন্দেহ বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আধডজনেরও বেশি রাজ্য ইতিমধ্যে তাদের অঞ্চলে সিবিআই অভিযানের ‘সাধারণ সম্মতি’ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
সম্ভাব্য সাংবিধানিক-সংকটটির অন্তর্নিহিত উত্তেজনার সবচেয়ে সুস্পষ্ট এবং দৃশ্যমান উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ। গত মাসে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জয়লাভের পর থেকেই, বিদ্রোহী এবং উদীয়মান রাজ্য নেতৃত্ব বনাম আহত এবং বিক্ষুব্ধ কেন্দ্রের মধ্যে যুদ্ধের রেখা আঁকা হয়ে গিয়েছে। যেভাবে ভোটে তারা তুমুল পরাজিত হল, মনে হবেই, দিল্লির শাসনব্যবস্থা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেনে নিতে পারছে না। ফলে, বিষাক্ত নির্বাচনী প্রচার থেকে সরতে সরতে এই অসূয়া রোজকার প্রশাসনিক দায়িত্বের দিকে গড়িয়ে এসেছে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল আকস্মিক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আদেশে বাংলার মুখ্যসচিবকে দেশের রাজধানীতে স্থানান্তরিত করা, যে আদেশ ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মানতে অস্বীকার করেছেন। ফলস্বরূপ, কেন্দ্র এবং মমতা সরকারের মধ্যে অভূতপূর্ব মোকাবিলা।
রাজনৈতিক দোষারোপের সময় এটা নয়। যখন দিল্লি এবং কলকাতার একসঙ্গে কোভিড এবং ঘূর্ণিঝড়- এই দুই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে কাজ করার কথা, তার বদলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অহং এবং বৈপরীত্যময় রাজনৈতিক আখের কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে সাংবিধানিক ব্যবস্থাটিতে প্রায় ভাঙন ধরিয়ে দিল। রাতারাতি বাংলার শীর্ষ আমলাকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা মোদি সরকার কর্তৃক প্রতিরোধমূলক কাজ হিসাবে দেখাই যায়। এর কারণ কী? না, অভিযোগ: প্রধানমন্ত্রী যখন ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনা করতে রাজ্যে এসেছিলেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে নাকি ৩০ মিনিট অপেক্ষা করিয়েছিলেন। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রী যদি পর্যালোচনা সভায় যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও বেশি সৌজন্য দেখাতে পারতেন, তাহলেও যোগাযোগ সুসংহত করার প্রাথমিক দায়িত্ব কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরই। তিনবারের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এই সম্মানের অধিকারী: তাঁকে কোনওভাবেই রাজ্যের রাজ্যপাল, যিনি কিনা ভয়ংকরভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিরোধী নেতা, যাঁর কিনা একমাত্র ভূমিকা মনে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে হয়রান করা- তাঁদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একাসনে বসানো যাবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করতে চাইতেন, তবে তা সহজেই আয়োজন করা যেতে পারত। তাছাড়া, সরকারি কর্মকর্তারা কেন তাঁদের রাজনৈতিক কর্তাদের খেলার দুর্ভাগা শিকার হবেন? হতাশার বিষয় হল, তীব্র বিরোধিতার কারণে সৎভাবে আলাপ-আলোচনা এবং ঐকমত্যের জন্য খুব কমই জায়গা বাকি পড়ে থাকে।
পাকেচক্রে, মোদি নিজেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বহু বছর ধরে তাঁর নানা অভিযোগের মধ্যে একটি অভিযোগ এই ছিল যে, কেন্দ্র প্রতিনিয়ত পিছনে পড়ে রয়েছিল। এমনকী, ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আয়োজিত ‘ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিল’ মিটিং, যেখানের আলোচ্য বিষয় ছিল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিল- সেই বৈঠকে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। মোদি ততদিনে বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী এবং তাঁর সমর্থকরা অভিযোগ করেছিল যে, এই বৈঠকটি শুধুমাত্র তাঁর রাজনৈতিক উত্থানে আঘাত হানতেই ডাকা হয়েছিল। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একসময় মোদি প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে খোলামেলাভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন, অভিযোগ করেছিলেন যে, রাষ্ট্রের তাঁর প্রতি আচরণ আসলে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অবজ্ঞা করা।
আজ অবশ্য মোদি প্ল্যানিং কমিশন তুলেই দিয়েছেন। অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের কাজ ছিল নিয়মভিত্তিক পদ্ধতিতে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতগুলি সমাধান করা। পরিবর্তে, প্রধানমন্ত্রী এখন কোভিড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠককালে সরাসরি দেশব্যাপী জেলা আধিকারিকদের তলব করেন। যদি স্বভাবোচিতভাবে নরমসরম মানুষ, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে বিশ্বাস করা হয়, তবে, তাঁর কথামতোই বলতে হয়- এই বৈঠক কেবল প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’, মুখ্যমন্ত্রীদের পদক্ষেপের কথা শোনার কোনও লক্ষ্য সেখানে নেই। এটা কি আসলেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, যার জন্য কিনা একসময় প্রধানমন্ত্রী আকুল হয়েছিলেন, না কি এ কেবল এক কর্তৃত্বপরায়ণ ‘বিগ বস’ জাতীয় নেতৃত্বব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি, যা ভিন্নমত বা কোনও বিকল্প শক্তি কাঠামো সহ্য করতে পারে না?
পুনশ্চ যেহেতু লাক্ষাদ্বীপের উদ্বেগই এই লেখাটি লিখতে আমাকে বাধ্য করেছিল, ফলে এই দ্বীপপুঞ্জকে নিয়েই লেখাটার সমাপ্তি টানা যাক। লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক প্যাটেল বলেছেন যে, তিনি লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন সম্ভাবনা আরও প্রসারিত করতে মদের উপর নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নিতে চান। সতর্কতার সহিত হলে এই প্রস্তাব উত্তম। গুজরাতের প্রাক্তন মন্ত্রী কি নিজ রাজ্যে এই নিষেধাজ্ঞার আইনের জন্য অনুরূপ বিধি প্রস্তাব করবেন?