সুমন করাতি, হুগলি: এবার হুগলিতেও হবে কালীঘাট দর্শন! শুনে অবাক হলেও দিন কয়েকের মধ্যে এটাই হয়ে উঠবে বাস্তব। কলকাতার কালীঘাট মন্দিরের আদলে তৈরি হচ্ছে হরিপালের শ্রীপতিপুর পশ্চিম গ্রামের সবুজ কালীর নতুন দেবালয়। সবুজ কালী নামটা চেনা লাগছে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। শ্রীপতিপুরের অধিকারী বছর ধরে ৭৫ বছর ধরে পূজিতা সেই কালী প্রতিমা, যার বিশেষত্ব তার গাত্রবর্ণ। এবছর, ৭৫ তম বর্ষ উপলক্ষে মন্দিরটি নতুন করে তৈরি হচ্ছে। তা যেন কালীঘাট মন্দিরেরই ছোট সংস্করণ। কাজ চলছে জোরকদমে। রটন্তি কালীপুজো তিথিতে এর উদ্বোধন হওয়ার কথা। এলাকাবাসী বলছেন, শুধু সবুজ কালী দর্শনই নয়, 'মিনি' কালীঘাট মন্দিরের টানে আরও বেশ ভক্তসমাগম হবে এখানে।
হরিপালের সবুজ কালী কেন এত বিখ্যাত? উত্তর পেতে একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখতে হবে। শ্রীপতিপুর পশ্চিম গ্রামের এক দরিদ্র গোঁড়া বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বটকৃষ্ণ অধিকারী নামে এক ব্যক্তি। বৈষ্ণবসুলভ আচরণ ছোট থেকেই জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করার পর কিছু বছর ভিনরাজ্যে চাকরি করেন তিনি। তারপর ভাগ্যচক্রে আবারও গ্রামে এসে চাষাবাদ করতে শুরু করেন। সব ঠিকঠাক চলার পর একপ্রকার জোর করেই পরিবার সূত্রে আঙুরবালা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বটকৃষ্ণ অধিকারী। কিন্তু সংসারে তাঁর মতি ছিল না। মাঠঘাট-শ্মশানে ঘুরে বেড়াতেন।
কালীঘাট মন্দিরের মিনি সংস্করণ নির্মীয়মাণ। নিজস্ব ছবি।
এভাবেই কয়েক বছর চলার পর জানা যায়, কোনও এক মাঠে তিনি গরুর খুঁট বাঁধছিলেন। সেই মুহূর্তে তাঁর পিছন থেকে সাদা বস্ত্র পরিহিত সন্ন্যাসী এসে বলেন, অমুক স্থানে অমুক সময়ে বটকৃষ্ণ অধিকারীর দীক্ষা হবে। পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা অবশ্য সম্পূর্ণ গোপনী। জনশ্রুতি, তিনি শ্মশানে সাধনা করতে করতে সিদ্ধি লাভ করে মা কালী ও কৃষ্ণের দর্শন পান। কিন্তু কুলীন বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম তাঁর বাড়িতে কেউ রাধাগোবিন্দের নাম না করে জলস্পর্শ করেন না, সেই বৈষ্ণব বাড়িতে কালীপুজো নিয়ে তৎকালীন সমাজের মাথারা বলেছিলেন, 'নৈব নৈব চ'। কিন্তু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে বটকৃষ্ণ অধিকারী বাড়িতে কালীর ঘট স্থাপন করলেন।পরে আবার মায়ের মূর্তি স্থাপনের স্বপ্নদর্শন হয়। কিন্তু এ কী? এ তো কালো বা নীল নয়, এ যে নব দুর্বার উপর শ্যাম ও শ্যামা একই অঙ্গে! কৃষ্ণ ও কালীর আদেশে বটকৃষ্ণ ঠাকুর রটন্তী কালীপূজার দিন প্রতিষ্ঠা করেন এই সবুজ কালীমূর্তি। এখানে দেবী পরম বৈষ্ণব।
রটন্তী কালীর পুরাণ অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকা যখন লীলা করছিলেন সেই খবর গিয়ে পৌছায় রাধিকার স্বামী আয়ান ঘোষের কাছে। রাধিকার স্বামী আয়ান ঘোষ এসে দেখেন, রাধিকা কালীপুজো করছেন। প্রেমিকাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কালীর রূপ ধারণ করেছিলেন, যা কৃষ্ণকালী নামে পরিচিত। রাধিকার কালীপূজার এই কথা রটে গিয়েছিল বলে এই তিথিতে কালী পূজাকে 'রটন্তি কালীপূজা' বলা হয়, এখন বটকৃষ্ণ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র কালীপদ অধিকারী (পণ্ডিত শিবানন্দপুরী) এই পঞ্চমুণ্ডির মন্দিরে সাধনা করেন। আর সারা বছর এই বৈষ্ণব বাড়িতে পূজিতা হন সবুজ কালী। সারাবছর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন সবুজ কালী দেখতে।
সবুজ কালীর অন্দরসজ্জায় কালীঘাট মন্দিরের ছাপ। নিজস্ব ছবি।
এবছর সবুজ কালীর ৭৫ তম উৎসব উপলক্ষে তৈরি হচ্ছে নতুন মন্দিরটি, যা দেখতে কালীঘাট মন্দিরের মতো। উদ্বোধন হবে আসন্ন রটন্তি কালী পূজা তিথিতে। সবমিলিয়ে এখন অধিকারী বাড়িতে উৎসবের আয়োজন ঘিরে ব্যস্ততা চরমে। এখন থেকে শুধু সবুজ কালীই নয়, সঙ্গে হুগলির 'কালীঘাট মন্দির' দেখতে আরও বেশি ভিড় জমাবেন ভক্তরা, আশা সকলের।
