বিশ্বদীপ দে: আগুনের পরশমণি। যা প্রাণে ছোঁয়ালেই জীবন পুণ্য হয়ে ওঠে। পিতৃমাতৃহীন এক যুবা, ডিজে হয়েই যার জীবন কাটছিল সাধারণের ভিড়ে, আচমকাই সে যদি আবিষ্কার করে তার শরীরে রয়েছে এমনই এক পরশমণির শক্তি, যা আঁধারের শরীরে আলোর ফুলঝুরি ফুটিয়ে তুলতে পারে তাহলে কী হবে? বহু প্রতীক্ষিত ‘ব্রহ্মাস্ত্র পার্ট ১: শিবা’ (Brahmastra Part One: Shiva) ছবিটি দেখতে যাওয়ার আগে এইটুকু আমাদের জানাই ছিল। আশৈশব শিবা (রণবীর কাপুর) জানত আগুন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এই গোপন সত্যিটাকে সঙ্গে নিয়েই তার দিনযাপন। কিন্তু আচমকাই তার মাথার ভিতরে ভেসে আসতে থাকে সংকেত। সে বুঝতে পারে তার জীবনে কোনও বড় পরিবর্তন আসছে। অদেখা ঘটনা ও অচেনা মানুষরা ভিড় করছে চেতনায়। আর এখান থেকেই গল্প দানা বাঁধতে থাকে নিজের মতো করে।
ছবির একেবারে শুরুতেই জানা যায় ব্রহ্মাস্ত্রের কথা। জানা যায়, অগ্নি অস্ত্র, জল অস্ত্রের মতো আরও কিছু অস্ত্রের কথাও। কিন্তু সব অস্ত্রের সেরা যে ব্রহ্মাস্ত্র, তা বলাই বাহুল্য। হিন্দুধর্মে উল্লিখিত এই অস্ত্রই ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে অহরহ উল্লেখ মেলে এই অস্ত্রের। স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা এই অস্ত্রের সৃষ্টিকর্তা। সমগ্র সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে যার। সেই অস্ত্রকেই এই ছবির নিউক্লিয়াসে বসিয়েছেন পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায়।
[আরও পড়ুন: ৪১ হাজারি টি-শার্ট পরে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় হাঁটছেন রাহুল! কটাক্ষ বিজেপির]
ব্রহ্মাস্ত্র তিনটি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই তিন টুকরোকে একত্র করতে পারলেই অসাধ্য সাধন। সেই টুকরোগুলি উদ্ধার করাই অন্ধকারের সম্রাজ্ঞী জুনুনের (মৌনী রায়) লক্ষ্য। কিন্তু সে মোটেই আঁধার জগতের সর্বময় কর্তা নয়। সে বলতে গেলে স্যাটেলাইট। তাকে যে পাঠিয়েছে সে রয়েছে গোপনে। কে সে? ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে কী করতে চায় সে? ছবি যত এগিয়েছে, পরতে পরতে খুলেছে সেই রহস্য।
এর আগেও এই গোত্রের ফ্যান্টাসি ছবি তৈরির চেষ্টা করেছে বলিউড। কিন্তু প্রায় কোনও প্রয়াসই সফল হয়নি। সেই ব্যর্থতা ঢেকে দিতে পারে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। আজকের ভারতে হিন্দুত্ব একটা বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। অয়নের এই ছবিতে দুর্গাপুজো, কালীপুজোর আবহ এসেছে। এবং অবশ্যই রয়েছে ব্রহ্মাস্ত্রের অনুসন্ধান। সনাতন ভারতের ধারণার সঙ্গে দারুণ ভাবে মিলে যায় সবটা।
[আরও পড়ুন: রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে জাতীয় শোক ঘোষণা ভারতের]
ছবির মূল মেজাজ আমাদের সকলের চেনা। সেই আলো ও অন্ধকারের লড়াই। দেখতে দেখতে মনে পড়বে ‘স্টার ওয়ার্স’, এমনকী ‘হ্যারি পটারে’র কথাও। আর মার্ভেল ইউনিভার্স তো আছেই। কেবল মেজাজই নয়। অত্যন্ত উন্নত ভিএফএক্সের প্রয়োগ মনে পড়িয়ে দেবে আয়রনম্যান, স্পাইডারম্যানদের জগৎকে। তবে শেষ পর্যন্ত একটা স্পষ্ট ফারাকও রয়েছে। ওই ধরনের ছবিগুলিতে প্রেম থাকে, কিন্তু এই ছবিতে রয়েছে জমজমাট গানও। এর মধ্যে ‘কেসারিয়া’ তো ইতিমধ্যেই বিরাট হিট। যতই ফ্যান্টাসি হোক, ‘কানু বিনে গীত নাই’ যেমন, তেমনই ‘গীত বিনে’ বলিউডকেও ভাবা যায় না। এই মুহূর্তে বলিউডকে বয়কট করার দাবি ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এহেন পরিস্থিতিতে ৪১০ কোটি টাকা ব্যয় করে একটি ছবি তৈরি যে প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য। তবে পরিচালক নেহাতই প্রেমের দৃশ্য বা গান ঢুকিয়ে ছবির বাণিজ্য নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, তা বলা যায় না। ঈশার (আলিয়া) সঙ্গে শিবার সম্পর্ক ছবির মূল গল্পেরও এক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবেই তুলে ধরেছেন অয়ন।
সদ্য মুখ থুবড়ে পড়তে দেখা গিয়েছে আমিরের ‘লাল সিং চাড্ডা’কে। কী আছে ব্রহ্মাস্ত্রের ভাগ্যে তা সময়ই বলবে। তবে ছবির প্রায় শুরুতেই শাহরুখ খানের বহু প্রতীক্ষিত ক্যামিও দেখে দর্শকের উচ্ছ্বাস বুঝিয়ে দেয়, প্রত্যাশা কিন্তু রয়েছে। একই ভাবে নাগার্জুন ও অমিতাভকে দেখেও মর্নিং শোয়ের দর্শকের হাততালি, সিটি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। যদিও আশঙ্কাও রয়েছে। ‘ওয়েক আপ সিড’ ও ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র মতো ছবির পরিচালক অয়ন এই ছবির গল্প বুনতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশই করেন। তবে ট্রিটমেন্টে গল্পের খামতি অনেকটাই ঢেকে যায়। আগেই বলেছি, ভিএফএক্সের চোখধাঁধানো চমক মুগ্ধ করবেই।
অভিনয়ে গুরুর চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন (Amitabh Bachchan) যথাসাধ্য করলেও চিত্রনাট্য তাঁকে খুব বেশি সুযোগ দেয়নি। এই ছবি আসলে ট্রিলজি। তাই পরবর্তী পর্বে হয়তো অমিতাভকে আরও বেশি জায়গা দেওয়া হতে পারে। কিন্তু প্রথম পর্বে তাঁর ভূমিকা সীমিতই। উলটো দিকে, স্বাভাবিক ভাবেই নায়কের চরিত্রে রণবীর কাপুরকে (Ranbir Kapoor) সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার তিনি করে উঠতে পারেননি। শিবার মানসিক দ্বন্দ্ব আরও একটু গভীর ভাবে ফোটানো যেত বলেই মনে হয়। বিশেষ করে তাঁর মতো অভিনেতার কাছে আমাদের প্রত্যাশা যে আরও বেশি।
তবে আলিয়ার সঙ্গে রোম্যান্সের দৃশ্যগুলিতে তিনি চমৎকার। দু’জনের রসায়ন এই ছবির অন্যতম ইউএসপি। চোখ ফেরানো যায় না আলিয়ার (Alia Bhatt) দিক থেকে। সব দৃশ্যেই তিনি সুন্দর। একই ভাবে ঝকঝকে রণবীরও। ছবির শেষে রয়েছে পরের পর্বের ঘোষণা। যে পর্বের নাম ‘দেব’। সেই ছবিতে গল্প কোনদিকে যেতে পারে তার ইঙ্গিতও রয়েছে। কিন্তু সেটা অনেক দূরবর্তী ব্যাপার এই মুহূর্তে। বয়কট ট্রেন্ডের সঙ্গে লড়াই করে শিবার আগুন বলিউডকে কোনও নতুন দিশা দেখাতে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার। সম্ভাবনা কিন্তু রয়েছে।