চারুবাক: পরিচালক তথাগত ভট্টাচার্য এবং চিত্রনাট্যকার সলিল সরকার ‘আকরিক’ (Akorik) নামের আড়ালে সত্যিই প্রায় সোনার আকর তুলে এনেছেন। সোনার আকর থেকে প্রকৃত সোনা পাওয়ার জন্য যে শ্রম ও বিভিন্ন জটিল পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এই ছবিটি থেকেও বক্তব্যের সোনাটুকু দর্শককে উদ্ধার বা আবিষ্কার করতে তেমনি শ্রম করতে হবে।
ছবির অন্যতম নারী চরিত্র সেমন্তী (অনুরাধা) কোন রোগে আক্রান্ত সেটা বুঝতেই শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিয়ের পর শাশুড়ির সঙ্গে মতভেদ, একান্নবর্তী সংসারের ভাঙন, নিজের একমাত্র ছেলের প্রবাসী হয়ে যাওয়ার জন্য একাকীত্ব, নাকি স্বামীর আন্তরিক সঙ্গ না পাওয়া — কোন কারণ ছবির শুরু থেকেই সেমন্তীকে কঠিন রোগে অসুস্থ রাখল? প্রশ্নের উত্তর পেতে অনেকটা অপেক্ষা করতে হয়। সে যাই হোক অসুস্থ স্ত্রীর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তাকে পাহাড়ে নিয়ে যায় স্বামী অরুণাভ (ভিক্টর)।
আর একই জায়গায় এসেছে বাংলা সিনেমা ও সিরিয়ালের চিত্রনাট্য লেখিকা ডিভোর্সি সৃজিতা (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত)। নতুন ছবির স্ক্রিপ্ট লিখতে কিশোর সন্তান আকাশকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে সে। সৃজিতার স্বামী আবার বিয়ে করেছে এবং তার একটি সন্তানও আছে। আকাশ বাবাকে স্বীকারও করে না। পাহাড়ি নির্জন এলাকায় একা একা ক্রিকেট খেলতে গিয়ে তার আলাপ হয় বর্ষীয়ান অরুণাভর সঙ্গে। অচিরেই অসমবয়সী সখ্যতা গড়েও ওঠে। সেটা নিয়েও সেমন্তীর অকারণ উদ্বেগ। হয়তো মনের কোণে আকাশের তরুণী মায়ের সঙ্গে অরুনাভর কোনও সম্পর্ক হওয়া নিয়ে সন্দেহ!
[আরও পড়ুন: দ্বিতীয় স্ত্রীর পর্ন ভিডিও তৈরি করেন আদনান সামি! বিস্ফোরক শিল্পীর ভাই]
সেমন্তী-অরুণাভর সন্তান অল্প ক’দিনের জন্য বাড়ি ফিরে শুধু বাবাকে জানিয়ে যায় বিদেশে তার বিয়েও ভেঙে গিয়েছে। চিত্রনাট্যে এত ঘটনার টুকরো টুকরো উপস্থিতি মাঝে মধ্যে ভাল লাগলেও, একটা সময় ক্লান্তি এনে দেয়। চিত্রনাট্যের কেন্দ্রবিন্দু অরুণাভ, সেমন্তী, সৃজিতা, নাকি কিশোর আকাশের মানসিক একাকীত্ব ও অস্থিরতা কোনওটাই পরিষ্কার হয়না। শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত রুচিশীল অরুণাভরও একাকীত্ব আছে, সেমন্তীর অসুস্থতাও মানসিক একাকীত্বের – কিন্তু চিত্রনাট্য সঠিক ব্যালান্স রাখতে না পারায় জটিল হয়ে ওঠে ছবি। পরিচালক তথাগত এমন ডিসব্যালান্সড চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ফোকাস হারিয়ে ফেলেছেন। তবুও তাঁর পরিচালনার কাজে কিন্তু বেশ কিছু সুন্দর ও মনে রাখার মতো দৃশ্য উপহার দিয়েছেন। আকাশ ও অরুণাভর সম্পর্কটির মধ্যে কোথায় যেন অরুণাভর অদেখা নাতির ছায়া এসে পড়ে। যেমন প্রবাসী ছেলেকে দেখার জন্য মা সেমন্তীর অলীক স্বপ্ন দেখা।
সংলাপে আজকের মাইক্রো সমাজের চেহারা চরিত্র নিয়ে কিছু অপ্রিয় সত্যের উল্লেখ ভাল।একমাত্র নিজের উন্নতি নিয়ে ব্যস্ত আমরা অনেকেই এখন এমন একাকীত্বের শিকার। রানা দাশগুপ্তর ক্যামেরা উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি অঞ্চলের সবুজ সৌন্দর্য সুন্দর ধরেছেন পর্দায় নাটকের মুড মাফিক। সুরকার দেবল বেরা “গোপন কথাটি রবে না গোপনে…” ব্যবহার না করলেও পারতেন। তবে “ভরা থাক স্মৃতিসুধায় হৃদয়ের পাত্রখানি…” এবং “জীবন পথের বাঁকে…” গান দু’টির ব্যবহার ছবির বক্তব্যকে কিছুটা স্পষ্ট করে।
এবার আসা যাক অভিনয়ের কথায়। প্রথম নাম ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি অরুনাভর অসহায়তা, অন্তর্দ্বন্দ্ব বেশিরভাগ সময় নিরুচ্ছার অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সেমন্তীর চরিত্রে অনুরাধা রায় অত সুন্দর সেজেগুজে অসুস্থতার ভান আর কতটুকু করতে পারেন! ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত সত্যি বলতে চিত্রনাট্যে সেকেন্ড লিড। তিনি কিন্তু সৃজিতার চরিত্রের স্পিরিট ও মানসিক অস্থিরতা আত্মস্থ করে চরিত্রটিকে বিশ্বাস্য করে তুলেছেন। আকাশের চরিত্রে অঙ্কন মল্লিক ও অন্যান্য চরিত্রে অঙ্গনা বসু,, জয়শ্রী অধিকারী বেশ স্বাভাবিক।
তবে কিনা ঘটনার ঘনঘটায় চরিত্রগুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানসিক সংঘাত, অনুচ্চারিত ব্যথা ও যন্ত্রণা যেন ঠিকভাবে প্রকাশ হল না। সিনেমার ব্যাকরণে সাজানো হলেও ‘আকরিক’ সত্যিই আকরিক রয়ে গেল, সোনার নিষ্কাশন হল না।
ছবি- আকরিক
অভিনয়- ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অনুরাধা রায়, মাস্টার অঙ্কন মল্লিক, অঙ্গনা বসু, সুপ্রতীম রায় প্রমুখ
পরিচালনায় – তথাগত ভট্টাচার্য