আর জি কর কাণ্ডে ঋতুপর্ণ ঘোষের 'দহন'-এর কথা মনে পড়ছে তিলোত্তমার। পরিচালকের জন্মদিনে সেই ছবিরই স্মৃতি ধরা পড়ল অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর কলমে।
আজকে ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্মদিন। খুবই স্পেশাল একটা দিন। তবে আজকে আমাদের যা পরিস্থিতি তাতে খুবই খারাপ একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। অনেক যুগ ধরে বঞ্চনা, নির্যাতন মেয়েদের উপর চলছে। তারই কিছু প্রেক্ষাপট নিয়ে ঋতুদা তুলে ধরেছিলেন 'দহন'। সেটা আমার কাছেও একটা রেভেলেশন ছিল। তখন আমি সবে সবে কেরিয়ার শুরু করেছি। অনেকটাই ছোট। সেখান থেকেই দেখতে পেয়েছিলাম, সমাজের চোখে একটা মেয়ের কী ধরনের অবক্ষয় এবং তাঁর চোখে সমাজকে নতুনভাবে পরখ করে। অদ্ভুত লেগেছিল সেই সময়। তখন আমার বিয়েও হয়নি। অনেক কিছুরই মর্ম বুঝিনি। পরে আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিলাম যে সমাজে মেয়েদের অবস্থানটা কী। এবং সুচিত্রা ভট্টাচার্যর এক অনবদ্য লেখার মধ্যে দিয়ে রোমিতাকে বুঝতে পেরেছিলাম। জেনেছিলাম, কীরকম মানসিক অত্যাচার চলতে পারে একটা মেয়ের উপরে। বাইরের জগতে তো নিরাপদ ছিলই না। এমনকী সে তার নিজের স্বামীর কাছেও নিরাপদ হতে পারে না! দেখা গিয়েছিল যে, তাকেই ভিক্টিম হিসেবে সমস্ত কিছু ফেস করতে হচ্ছিল। যারা এই অন্যায় করেছিল তারা অনেকটাই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেটাই বোধহয় হয়েই আসছিল আমাদের জীবনে। অনেকদিন ধরেই হয়ে আসছে। উপযুক্ত শাস্তি তারা কোনওদিনই পাচ্ছে না। আজও পাবে কিনা জানি না।
আশা রাখব, আজ সুবিচার পাওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি যে সারা পৃথিবী এটা নিয়ে আন্দোলন করছে। তবে জানি না আমরা আজও কতটা সেফ। কারণ, অনেক ঘটনা আমরা জানতেই পারি না। কিন্তু আমাদের সামনে আজকে যে আয়নার মতো পরিষ্কার হল আমাদের নিজেদের জায়গায়, নিজেদের কর্মক্ষেত্রে, নিজের গর্বের জায়গায় সেখানে এত বড় আঘাত! সত্য়ি আমরা কোথায় বাস করছি। এই প্রশ্নগুলো মাথায় কিলবিল করছে সারাক্ষণ। কিন্তু আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে আইন ও বিচার ব্যবস্থার উপর। আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে কবে তাঁদের কাছ থেকে আমরা সুবিচার পাব। তাই সুবিচারের জন্য যে আন্দোলন চলছে তা চলবে। এই সুবিচার আমাদের পেতেই হবে। নাহলে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে যাব। ভয়, আতঙ্কে ভিতরটা ছিন্নভিন্ন হতে থাকবে। আমরাও কি স্বাভাবিক থাকব! এরকম পরিবেশ নিয়ে কদিন মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকবে। আমরা যাই করি না কেন, আমাদের মাথার পিছনে সব সময়ই তিলোত্তমার কথা উঠে আসবে। সব সময় আমরা ভাবছি যে ওর আত্মা কখন শান্তি পাবে। যে চলে গিয়েছে, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্ত এররম অনেক তিলোত্তমাদের তো বাঁচাতে পারব আমরা। অনেক কঠিন এই সমস্য়া, অনেক কঠিন এই মানসিক যুদ্ধ। কিন্তু অপেক্ষা করব। প্রতিবাদে থাকব। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
ঋতুদার সঙ্গে অনেক মুহূর্ত রয়েছে। ভালোবাসা, বকুনি, অভিমান সব। অত্যন্ত গভীর মন আর ভীষণ সেনসেটিভ পরিচালক। অনেক কিছু শিখেছি। নারীমনকে কীভাবে বুঝতে হয়, উনি পারতেন বুঝতেন। না বলা কথা, প্রতিবাদ, প্রেম যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠত ওঁর সব কিছুতে। আমার বিয়ের সময় আমার চন্দনের তুলির বাঁক ঋতুদার করা। 'দহন'-এর সময় গল্পের মতো করে রোমিতাকে বুঝেছিলাম। তার সবকিছু। এক আনকোরা মেয়ে তখন আমি। যেন পুরোটাই রোমিতা হয়ে গিয়েছিলাম। সব কষ্ট যেন আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম। রোমিতা চরিত্রর সঙ্গে ঋতুদাই আস্তে আস্তে আমাকে পরিচয় করিয়েছিলেন। সুচিত্রাদির দহন সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ঋতুদা বুঝিয়েছিলেন, রাস্তায় যখন একটি মেয়ের শ্লীলতাহানি হয়, তাকে কেউ বাঁচাতে আসে না। একটি মেয়ে তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাকেও অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু সবাই ভিক্টিমের থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। তারাই যেন পরোক্ষভাবে অন্যায় করে ফেলেছে। এভাবেই তাদের প্রতিষ্ঠা করা হয়। আজও তাই হচ্ছে। অনেক কিছুই বদলায়নি। সেই জন্য়ই আমার মনে হয়, ধর্ষকেরই তো লজ্জিত হওয়া উচিত। তার সমাজে মুখ দেখানোর জায়গা না থাকতে পারে। কিন্তু আজও যে ধর্ষণের ভিক্টিম হচ্ছে, সে-ই যেন কোনও অন্যায় করে ফেলেছে বলে মনে হয়। এই দ্বন্দ্বটাই 'দহন' ছবির মধ্যে খুব ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। এখনও এরকমই হয়ে আসছে। এই যেমন, আর জি কর কাণ্ডের মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারি, এখনও প্রশ্ন উঠছিল, মেয়েটি কেন রাতে ওখানে ছিল? কী দরকার ছিল ওখানে থাকার? সে তো তাঁর সেমিনার রুমে বসে নাইট ডিউটি করছিল। কী অদ্ভুত কথা, সে কেন ছিল ওখানে! কেন মেয়েরা রাস্তায় বের হবে? কী অদ্ভুত প্রশ্ন। তার মানে অন্যদের আমরা আরও বেশি জায়গা করে দিচ্ছি তাঁদেরকে বোঝানোর যে, তোমরা রাত্রে বের হবে, তা মেয়েরা বের হবে না। কারণ, তোমরা তো অত্যাচারী পুরুষ। তোমরা তো মেয়েদের উপরে থাবা হানবে। এই জন্যই মেয়েরা বের হবে না। তার মানে কী ধরনের সমাজ, আজকে এই সেঞ্চুরিতে দাঁড়িয়ে আমাদের এটা মেনে নিতে হবে। তার মানে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হওয়া। শুধু দহন নয়, এই ধরনের চরিত্রে আমি আরও অভিনয় করেছি। যেমন, রাজা সেনের দেবীপক্ষ। সেখানেও মেয়েটি গর্জে উঠেছিল। সেখানে মেয়েটি নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছিল। দোষীকে মারতে পেরেছিল। আমাদের ভিতরে দুর্গা জেগে উঠেছে, এর শেষ তো দেখতেই হবে। আশা করি দেখতে পাব। ঋতুদা থাকলে, আরজি কর কাণ্ডে খুবই প্রভাবিত হতেন। তাঁর কাছে চ্য়ালেঞ্জের মতো হত। তাঁর ছবি এবং ঘটনা তাঁকে হয়তো পীড়া দিত মনে হয় আমার। তিনি নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করতেন।