কিংশুক প্রামাণিক, চট্টগ্রাম: রোহিঙ্গাদের (Rohingya) দেখলাম। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল কুতুপালং আসার। বাংলাদেশ (Bangladesh) সরকারই সেই সুযোগ করে দিল। পৃথিবীতে উদ্বাস্তু জীবন অভিশাপের মতো। দুই বাংলার বিচ্ছেদ হওয়ার পর উদ্বাস্তু স্রোত কাকে বলে তা আমরা তিন দশক ধরে দেখেছি। তবে একটি ক্যাম্পে এত মানুষের গাদাগাদি করে থাকা নজিরবিহীন! যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার চেয়েও অনেক বড় এই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ক্যাম্প। প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ মানুষ। যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও ভয়ংকর চিত্র।
কক্সবাজার (Cox’s Bazar) থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে কুতুপালংয়ের পাহাড়ি ঢালে পিলপিল করছে মানুষ। ‘শয়ে ‘শয়ে শিশু। গায়ে গায়ে দরমার ঘর। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বসতির ঘরগুলি যেমন নর্দমা পর্যন্ত নেমে যায়, তেমন। তার মধ্যে সংসার। এমন ৩৪টি ক্যাম্প তিরিশ কিলোমিটার জুড়ে। ২০১৭ সালে মায়ানমার সেনার (Myanmar Army) রক্তাক্ত হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে ওরা তিন-চার দিন হেঁটে জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে চলে এসেছিল নাফ নদীর ওপারে। তারপর নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ। দুর্গম পথে মৃত্যুমিছিল নেমেছিল। উত্তাল নদীতে নৌকা ডুবে মারা গিয়েছিল অনেকে। বলা ভাল, বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কার্যত তাড়া করে ‘মুসলমান’ (Muslim) রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করেছিল ‘বৌদ্ধ’ মায়ানমারের সেনা। যারা তাও যায়নি নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে শুধুই কি ধর্মীয় ব্যাপার ছিল, নাকি আরাকানের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ হস্তগত করার উদ্দেশ্য ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
[আরও পড়ুন: ‘হিন্দুদের এত ঘৃণা কেন?’ গঙ্গা আরতিতে পুলিশের অনুমতি না মেলায় মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা BJP’র]
বাস্তব হল, চূড়ান্ত অমানবিক এক অভিযান চালিয়েছিল শান্তির দূত গৌতম বুদ্ধের পূজারিরা। আরাকানি বাংলা দুর্বোধ্য। সাড়ে ১০ লক্ষ মানুষকে সেদিন থেকে গ্রহণ করে ভরণপোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই পাঁচ বছরে ২ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়েছে। বিশ্বের কাছে বার বার আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব হাসিনা ছাড়া কেউ নিতে চায়নি। তবে রাষ্ট্রসংঘ (UN), নানা মানবাধিকার সংগঠন, মধ্যপ্রাচ্যের নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বোর্ড চোখে পড়ল। সবাই মিলে উদ্বাস্তু মানুষগুলোর সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করছে। স্কুল চালু হয়েছে। রোগ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কী এসে গেল মকবুল, নুর, সায়রাদের? সবার এক কথা, খাওয়া, থাকার অভাব নেই। তিন বেলা সব জুটে যায়। কিন্তু কারও কাজ নেই। হাতে নেই পয়সা। এভাবে জীবন চলে না। ক্যাম্প এলাকা থেকে বেরোনর অনুমতি নেই। কার্যত বন্দি হয়ে থাকা। কেউ চায় ঘরে ফিরতে। কেউ চায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। লক্ষ করছিলাম, ইতিউতি বাজার বসেছে। চায়ের দোকান, সেলুন, স্টেশনারি সামগ্রী, মুদিখানা ইত্যাদির দোকান। পথে ফেলে বিক্রি হচ্ছে শীতের পোশাক। কিন্তু কিনবে কে?
[আরও পড়ুন: ক্রমেই বাড়ছে ফাটল, হোটেল-সহ যোশিমঠের একাধিক বাড়ি ভাঙছে উত্তরাখণ্ড সরকার]
এ তো গেল একদিক। ক্যাম্প ঘিরে রয়েছে ভয়ংকর সব অভিযোগও। রাত হলেই এলাকায় চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। খুন, ধর্ষণ, জুয়া নাকি নিত্য ব্যাপার। দারিদ্র অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এখানে ঘাঁটি গাড়ছে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক জঙ্গি। এত ঘিঞ্জি এলাকায় কোথায় কী হচ্ছে তা ধরা খুব কঠিন। এটাই স্বাভাবিক। বন্দি জীবন মানুষকে অপরাধী করে তোলে। স্বাধীনতা পেতে মন চায়। সেই লক্ষে উলটো রথও। রোহিঙ্গারা মিশে যেতে শুরু করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভিড়ে। বিরাট এলাকায় এত মানুষ। ক্যাম্পের বাইরে কোথাও বেড়া নেই। কেউ যদি মনে করে বাস ধরে কক্সবাজার চট্টগ্রাম চলে আসবে, কোনও বাধা নেই। সবাই মুসলমান। ফলে পোশাক চেহারা দেখে পার্থক্য করার উপায় নেই।
একটা সময় মনে করা হত, ক্যাম্পের বাইরে গেলেই ভাষা সমস্যায় পড়বেন রোহিঙ্গারা। ঠিক ধরা পড়ে যাবেন। কিন্তু আশ্চর্য, আমি যে ক’জনের সঙ্গে কথা বললাম, সবাই বাংলাদেশিদের মতোই কথা বললেন। অর্থাৎ তাঁরা রপ্ত করে ফেলছেন চট্টগ্রাম (Chittagong), কক্সবাজারের বাংলা। শিখে নিচ্ছেন সব আদবকায়দা। তাই আগামী দিনে ১৭ কোটি বাংলাদেশির ভিড়ে সাড়ে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা মিশে গেলে অবাক হওয়ার থাকবে না। যুগে যুগে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে যা হয়েছে।