বিপদের দিনে বড় বাঁচোয়া হতে পারে সঞ্চয়। সেভিংস-এর গুরুত্ব আজ নয়, বহু আগে ঘরে ঘরে মা-ঠাকুরমা-দিদিমারাই বুঝিয়েছেন, লক্ষ্মীর ভাঁড়ে একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে। সময় যত এগিয়েছে, সঞ্চয়-এর কৌশলেও এসেছে বৈচিত্র, এসেছে নতুনত্ব। তবে গুরুত্ব আজও কমেনি। আজকের সঞ্চয় এখনও ভবিষ্যতের ভরসা। কলমে বন্ধন ব্যাংকের এমডি এন্ড সিইও চন্দ্রশেখর ঘোষ
ভবিষ্যতের অদেখা অজানা সময়ের অনিশ্চয়তা থেকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত থাকার জন্যেই সঞ্চয়। রোজকার খরচ-খরচার পরে উদ্বৃত্ত অর্থ জমিয়ে রাখার দিন আর নেই। এখন সঞ্চয়ের পরিমাণ ধরেই মাসিক ব্যয়ের হিসাব করতে হবে। আর এই অভ্যাস শুরু করতে হবে জীবনের গোড়ার দিকেই।
আগেকার দিনে আমরা শুনেছি, অধিকাংশ বাড়িতেই মায়েরা রান্নার চাল নেবার সময়ে কুলদেবতার নাম করে এক মুঠো তুলে রাখতেন অন্য একটি পাত্রে। মাসের শেষে, রোজ একটু করে তুলে রাখা ওই চালই অভাবের সংসারে ভাতের যোগান দিত। এ-ও কিন্তু সঞ্চয়ের এক সহজপাঠ। ঠিক এভাবেই চিরাচরিত প্রথায় বাড়িতে মাটির ভাঁড় রেখে তাতে পয়সা জমানোর অভ্যেস ছিল মানুষের। কিন্তু সামান্য প্রয়োজনেই সেই মাটির ভাঁড় ভেঙে ফেলা যেত এবং সহজেই জমানো পয়সা খরচ হয়ে যেত।
তাই সঞ্চয়ের জন্যে টাকা জমানো উচিত ব্যাংকে। নিরাপদে বাড়তে থাকবে সঞ্চিত অর্থ। আর এই জমানো অর্থই একদিন হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের পুঁজি। সেই পুঁজি একদিকে যেমন সংকটকালে আর্থিক সহায়তা দেবে, তেমনই আবার নতুন ব্যবসা শুরু করার মূলধন হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। ঋণ নেওয়ার সময়ে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে, যে ব্যক্তিগত পুঁজি ব্যাংকে দেখানোর দরকার হয়, সেক্ষেত্রেও উপকারে আসবে এই সঞ্চয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আমরা দেখেছি, সাংসারিক অনটনে বা কোনও জরুরি অবস্থায় বিষয়-সম্পত্তি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়। সময়মতো সঞ্চয় শুরু করতে পারলে, সেই সঞ্চিত অর্থ পরিবারের সম্পত্তি বা বসতবাড়িকে বিক্রি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। সর্বোপরি, সমগ্র পরিবারটিকে রক্ষা করতে পারে।
কিন্তু এই সঞ্চয়ের সুঅভ্যাস শুরু করতে হবে শৈশব থেকেই। পরিবারের ছোটদের জন্য ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া যেতে পারে। স্ত্রীয়ের নামেও করা যেতে পারে, সিঙ্গল বা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। নিজের নামে অ্যাকাউন্ট থাকলেও নিয়মিত সেই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়ার অভ্যাস তৈরি হলে, ছোটরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের সেই সঞ্চয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। অর্থের অপচয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান তৈরি হয় ও সঞ্চয়ের সুবিধাগুলি ভালভাবে বুঝতে সুবিধা হয়। ছোট থেকেই ভবিষ্যতের জন্যে আর্থিক পুঁজি তৈরি করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়ে যায়।
[আরও পড়ুন: বুঝেশুনে লগ্নি করুন F&O-তে, মাথায় রাখুন এই বিষয়গুলি]
এখন ঘরে ঘরে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে। বেড়েছে ‘ডিসপোজেবল ইনকাম’। ব্যয়ের বাহুল্য সামলেও ছেলেমেয়েরা এখন সঞ্চয় ও বিনিয়োগ নিয়ে ভাবতে শিখেছে। কিন্তু এই সব কিছুর জন্যে চাই যথাযথ আর্থিক প্ল্যানিং ও বাজেটিং। আর এই বাজেটিং হতে হবে বাস্তবসম্মত। বর্তমান বাজারদর ও ভবিষ্যতে সেই দরের বৃদ্ধি আন্দাজ করেই সঞ্চয়ের পরিকল্পনা করা উচিত। বাজে খরচ কমিয়ে সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রতি মাসে একটু একটু করে বাড়ানোর চেষ্টা করে যেতে হবে।
মাসিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নিকেশে সঞ্চয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রয়োজনে অটোমেটিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে নিয়মিত সেভিংসের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি মাসে নিয়মমাফিক স্বল্প পরিমাণ আমানত জমা করার জন্যে রেকারিং ডিপোজিট খুব ভাল উপায়। অটোমেটিক ট্রান্সফার সেক্ষেত্রে ফোর্স-সেভিংস এর কাজ করবে। একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তার মধ্যে একটিকে শুধুই মাত্র সঞ্চয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
আজকাল ক্রমশই সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাঝের রেখাটি অস্পষ্ট হয়ে আসছে। সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও এখন সকলে রিটার্নের উপরেই বেশি জোর দিচ্ছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে সঞ্চয় হল আকস্মিক প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার মাধ্যম। শুধুমাত্র রিটার্নের কথা চিন্তা করে এমন কোনও জায়গায় বা স্কিমে সমস্ত অর্থ সঞ্চয় করা ঠিক হবে না, যেখান থেকে অর্থ সহজে ফেরতযোগ্য নয় বা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের উপর নির্ভরশীল। নিয়মিত সঞ্চয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সহজে ফেরতযোগ্য খাতে জমা করার পর বাকি অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করতে হবে।