মৃগাঙ্ক মণ্ডল: গত জুলাই মাসে প্রথম দেখা গিয়েছিল তাকে। তখন থেকেই তার রূপ, রং, চরিত্র নিয়ে নানা জল্পনা বিজ্ঞানী মহলে। সৌরমণ্ডলে ঢুকে একের পর এক গ্রহের পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেই ‘অদ্ভুত অতিথি’ এখন পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু ঘটনা হল, নীলগ্রহের পাড়া ছেড়ে সে আর নড়ছে না! গত কয়েক দিন ধরেই পৃথিবীর আশপাশে ঘোরাফেরা করে যাচ্ছে সে। শুধু তা-ই নয়, আগন্তুকের যা গতিবিধি, তাতে আরও কিছু দিন সে পৃথিবীর আশপাশে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়েই ঘুরে বেড়াবে। এতেই আশঙ্কা, নতুন অতিথি কোনও ভাবে পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়বে না তো?
এই ভবঘুরে নতুন অতিথি হল একটি ধূমকেতু। যার নাম ‘৩আই/অ্যাটলাস’রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এই নাম খানিক যান্ত্রিক শোনালেও, মহাকাশ বিজ্ঞানে এর তাৎপর্য যথেষ্ট গভীর। কারণ এটি কোনও সাধারণ ধূমকেতু নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি এসেছে আমাদের সৌরজগতের বাইরের কোনও এক অজানা নক্ষত্রজগত থেকে। যদিও এই ঘটনা নতুন নয়। ২০১৭ সালে ‘ওউমুয়ামুয়া’ এবং ২০১৯ সালে ‘টু-আই/বরিসভ’ ধূমকেতুও একই ভাবে আমাদের সৌরজগতে ঢুকে চমকে দিয়েছিল বিজ্ঞানীদের।
ধূমকেতু '৩আই/অ্যাটলাস' প্রথম ধরা পড়ে অত্যাধুনিক ‘অ্যাটলাস’ (অ্যাস্টেরয়েড টেরেস্ট্রিয়াল ইমপ্যাক্ট লাস্ট অ্যালার্ট সিস্টেম) টেলিস্কোপে। আগন্তুকের গতি, কক্ষপথ ও গতিপথ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, এটি সূর্যের মহাকর্ষে বাঁধা নয়। বরং, এটি এমন এক গতিপথে চলছে, যা স্পষ্ট ভাবে ইঙ্গিত দেয়, এটি আমাদের সৌরজগতের ‘স্থানীয় বাসিন্দা’ নয়। মহাকাশের গভীর অন্ধকার থেকে বহুদূরের এক গল্প নিয়ে ছুটে এসেছে সে।
এই ধরনের ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম যে প্রশ্নটা মাথায় আসে, তা হল -- রহস্যময় এই আগন্তুক কি পৃথিবীর জন্য কোনও বিপদের কারণ হতে পারে? বিজ্ঞানীরা আপাতত আশ্বস্ত করছেন, এই ধূমকেতুর সঙ্গে পৃথিবীর সরাসরি সংঘর্ষের কোনও সম্ভাবনা নেই। এটি পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে গেলেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই অতিক্রম করবে। ধূমকেতুটি এখন পৃথিবী থেকে প্রায় ১.৮ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে অবস্থান করছে, যা সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের প্রায় দেড় থেকে দু’গুণ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৯ ডিসেম্বর ধূমকেতুটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল। সেই সময়ে পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব ছিল প্রায় ২৭ কোটি কিলোমিটার। মহাকাশ বিজ্ঞানে যা 'নিকট' বলেই ধরে নেওয়া হয়। এই অবস্থান নিরাপদ বলেই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানে এটি কেবল একদিনের ঘটনা নয়। ১৯ ডিসেম্বরের আগে ও পরে মিলিয়ে প্রায় ১০-২০ দিন ধরে ধূমকেতুটি পৃথিবীর কাছাকাছিই থাকবে।
তবুও সংঘর্ষের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না বিজ্ঞানীদের একাংশ। তাঁদের মত, এই ধরনের আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুগুলির গতিবিধি পুরোপুরি অনুমান করা এখনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এদের গতি অত্যন্ত বেশি এবং সৌরজগতের পরিচিত গ্রহাণু বা ধূমকেতুর তুলনায় অনেকটাই আলাদা। তার উপর এদের রাসায়নিক গঠন, ভৌত বৈশিষ্ট্য এবং অভ্যন্তরীণ গড়ন সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞান সীমিত। পৃথিবীর এত কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ধূমকেতুটির আলো প্রতিফলন, ধূলিকণা ও গ্যাস নির্গমনের ধরন বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জানতে চাইছেন - আমাদের সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্রজগতে গ্রহ ও ধূমকেতু কী ভাবে তৈরি হয়। কোটি কোটি বছর আগে অন্য কোনও নক্ষত্রের আশপাশে জন্ম নেওয়া এই ধূমকেতু আজ আমাদের সৌরজগৎ ছুঁয়ে যাচ্ছে, এই ভাবনাটাই মানব সভ্যতার জ্ঞানভাণ্ডারে এক নতুন মাত্রা যোগ করছে।
(লেখক কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক)
