shono
Advertisement
Sergei Krikalev

'ফিরিবার পথ নাহি'! দেশ হারিয়ে মাসের পর মাস মহাকাশেই বন্দি ছিলেন রুশ নভোচর ক্রিকালেভ

কীভাবে ফিরেছিলেন মর্তে?
Published By: Biswadip DeyPosted: 06:46 PM Mar 30, 2025Updated: 06:50 PM Mar 30, 2025

বিশ্বদীপ দে: 'টার্মিনাল' ছবিটা সকলেরই দেখা। টম হ্যাঙ্কস অভিনীত সেই ছবির প্রধান চরিত্র দেশ হারিয়ে আটকা পড়েছিলেন বিমানবন্দরের টার্মিনালে। নিছক বানানো গল্প নয়, রুপোলি পর্দার ওই সাড়া জাগানো ছবির নেপথ্যে রয়েছেন ইরানের বাসিন্দা মেহরান করিমি নাসেরি। দেশহীন হয়ে দুই দশকের বেশি টার্মিনালে কাটিয়ে সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাতে হয় তাঁকে। একই পরিস্থিতি হতেই পারত ক্রিকালেভের। রুশ নভোচর সের্গেই ক্রিকালেভ। ১৯৯১ সালে তাঁকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময় তিনি অন্তরীক্ষেই। সোভিয়েত ভেঙে ১৫টি দেশ হল। দেশ হারালেন ক্রিকালেভ। কে ফেরাবে তাঁকে? এই সংশয় ক্রমেই দীর্ঘ করল বন্দিদশা। মাসের পর মাস ভাঙা শরীর-মনে অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। ৩১১ দিন পরে ফিরতে পেরেছিলেন। মাঝেই এতগুলো দিন তাঁর মনের উপরে কী ঝড় বয়ে গিয়েছিল তা ভাবতে বসলে বোঝা যায় কতটা করুণ সেই অভিজ্ঞতা।

Advertisement

আসলে এই ইতিহাস নতুন করে মনে করাচ্ছে সুনীতা উইলিয়ামসের প্রত্যাবর্তন। তিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন ৮ দিনের জন্য। যে যানে ফেরার কথা সেটা গেল বিগড়ে। তারপর থেকে ক্রমেই দীর্ঘ হয়েছে প্রতীক্ষা। কবে ফিরবেন কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। সোশাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যম, সর্বত্রই একটা টেনশনের স্রোত। অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছিল কল্পনা চাওলার কথা। তিনিও ছিলেন এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী। কিন্তু শেষপর্যন্ত পৃথিবীতে ফেরা হয়নি তাঁর। ফিরেছিল ঝলসে, কুঁকড়ে যাওয়া দেহাবয়বের ঝাপসা প্রতিবিম্ব মাত্র। আর সেই স্মৃতি, বলা উচিত দুঃস্মৃতিই যেন সুনীতার 'বন্দিত্ব' দশার উপরে আশঙ্কার কালো ছায়া হয়ে ফিরে আসছিল। শেষপর্যন্ত অবশ্য সব ভালোয় ভালোয় মিটেছে। পৃথিবীর মেয়ে ফিরেছে পৃথিবীর কোলে।

'মহাকাশ' শব্দটায় এমন গোলাপি রঙের রোম্যান্টিকতা লেগে থাকে যে, এই সব বিপত্তি না ঘটলে বোঝা যায় না জনমানবহীন মহাশূন্যে থাকার মধ্যে রোমাঞ্চ যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ভারহীনতা-সহ আরও নানা প্রতিকূলতা, অজানা বিপদের গাঢ় রক্তচক্ষু। একটা সময় এমনও ছিল, মানুষ অন্তরীক্ষে যাওয়ার কৌশল জানত, কিন্তু ফেরার উপায় তখনও আয়ত্তে আসেনি। আর তাই লাইকার মতো কুকুরকে সেখানে পাঠানোর সময়ই বিজ্ঞানীদের জানা ছিল সেই অবলা জীবটিকে আর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে না। স্পুটনিক ১ এর সাফল্যের পর ১৯৫৭ সালে স্পুটনিক ২ পাঠানো হয় মহাকাশে। তাতেই ছিল লাইকা। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই মহাকাশযানেই ভয় পেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায় সে। তাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফেরার সময় পুড়ে ছাই হয়ে যায় গোটা মহাকাশযানটি। ফলে মানুষ মহাকাশে যাওয়ার আগে থেকেই এই মৃত্যুছায়া সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। যা পরবর্তী সময়ে বহু মহাকাশচারীকেই ভুগিয়েছে। চেনা পৃথিবীর আঙিনা থেকে দূরে গিয়ে ঘরে ফেরার আকুতির চেয়েও তখন যেন বেশি হয়ে উঠতে থাকে অন্তত প্রাণে বেঁচে থাকতে পারার প্রার্থনাই। আর সেই আশঙ্কা অমূলক নয়। ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে যাওয়া প্রথম মানুষ বলে পরিচিত হলেও কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। আসলে তিনি পৃথিবীর প্রথম সফল মহাকাশচারী! যিনি মহাকাশে গিয়েও নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। তাঁরও আগে যাঁরা পৌঁছেছিলেন, তাঁদের নাম চলে গিয়েছে অতলে। মহাকাশের হিম অন্ধকারে একাকী মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে তাঁদের আর্তনাদ ভেসে এসেছিল পৃথিবীর বেতার তরঙ্গ বেয়ে। কিন্তু তাঁরা আর ফিরতে পারেননি। বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে জ্বলেপুড়ে গিয়েছিল তাঁদের নশ্বর শরীর। কিংবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে গিয়েছিল অনন্ত মহাশূন্যে। সাফল্যের আড়ালে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়ে যাওয়া সেই সব অচেনা মানুষদের করুণ বলিদান কিছুক্ষণের জন্য আমাদের স্তব্ধ করে দেয়। যে প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনও দিন মিলবে না তার ব্যর্থ অন্বেষণটুকুই থেকে যায়। আর তৈরি হতে থাকে এক প্রতি-ইতিহাস।

সের্গেই ক্রিকালেভের গল্পে ফিরি এবার। আসলে এই প্রেক্ষাপটটুকু বলে রাখা দরকার ছিল মহাকাশ যে কেমন বিপদসংকুল এক জগৎ তা বোঝাতেই। কিন্তু ক্রিকালেভ সেখানে যে পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তা অভূতপূর্ব। আজও। ১৯৯১ সালের ১৮ মে। কাজাখস্তানের বাইকোনুর মহাকাশ কেন্দ্র থেকে আকাশে উড়ল সয়ুজ মহাকাশযান। পাঁচ মাসের এক মিশনে এমআইআর মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছনো সেই যানেই ছিলেন 'অভাগা' ক্রিকালেভ। তিনি ওই স্টেশনে বসে নীল রঙের গ্রহের দিকে নজর রেখেছিলেন। কিন্তু অত উঁচু থেকে নিজের দেশের উপরে ঘনিয়ে আসা রাজনৈতিক 'ঝোড়ো মেঘ' তাঁর নজরে আসেনি।

এমনিতে ক্রিকালেভের এই মিশন ছিল নেহাতই রুটিন এক মিশন। স্টেশনের কিছু কলকব্জা সারানোর দায়িত্বটুকুই ছিল তাঁর কাঁধে। কিন্তু সবই বদলে গেল হঠাৎ। সোভিয়েত ভেঙে গেল। মহাকাশ স্টেশনে আটকে থাকা ক্রেকালেভ হয়ে উঠলেন 'সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নাগরিক'। এটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় মহাকাশ সফর। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না এই সফরশেষে 'বাড়ি' ফেরা হবে কিনা।

পরবর্তী সময়ে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ''পুরো ব্যাপারটাই ছিল অপ্রত্যাশিত। আমরা বুঝতেই পারিনি কী ঘটছে। যে সামান্য তথ্য দেওয়া হয়েছিল তা থেকেই পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।'' এও জানা যায়, সেই তথ্যও তাঁকে দিয়েছিল পশ্চিমি বিশ্ব। সোভিয়েত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত 'সব ঠিক আছে' বলে গিয়েছিল। এমনকী তাঁর স্ত্রী এলেনা তেরেখিনাও তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় কিছু বলেননি! সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচিতে একজন রেডিও অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন ভদ্রমহিলা। কেন এমনটা করেছিলেন তিনি? তাঁর দাবি ছিল, ''ওঁকে দুঃখের কথাগুলো বলতে পারছিলাম না। এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। আমার মনে হয়েছিল ও নিজেও তাই করছে।''

শেষমেশ ৩১১ দিন পরে পৃথিবীতে ফিরেছিলেন তিনি। তার আগে তাঁর কাছে পৌঁছেছিল এক রেডিও বার্তা। যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, কেউই আর এই মুহূর্তে তাঁর মিশনের জন্য দায়িত্ববান নয়। ফলে নতুন করে কেউ যোগাযোগ না করা পর্যন্ত তিনি যেন মহাকাশ স্টেশনেই থেকে যান।

ফুরিয়ে আসছিল অক্সিজেন। ভাঁড়ারে টান পড়ছিল। চোখের সামনে জেগে আছে পৃথিবী। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই পেশি ও হাড় দুর্বল হয়ে পড়ছিল ক্রিকালেভের। যোগাযোগ ক্ষীণতর হয়ে গিয়েছিল। রীতিমতো মানসিক অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ পৃথিবীতে ফেরেন ক্রিকালেভ। ফেরার সেই মুহূর্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, উচ্ছ্বাস ছিল না। তবে আনন্দ পেয়েছিলেন নিশ্চিত ভাবেই। কিন্তু এই ইতিহাস থেকে তৈরি হওয়া গল্পের শেষটা আরও অসাধারণ। মহাকাশে এভাবে আচমকা বন্দি হওয়ার ট্রমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ক্রিকালেভ ফের মহাকাশে গিয়েছিলেন। ২০০০ সালে তিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাওয়া প্রথম দলের সদস্য হন।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • রুশ নভোচর সের্গেই ক্রিকালেভ। ১৯৯১ সালে তাঁকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল।
  • সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময় তিনি অন্তরীক্ষেই। সোভিয়েত ভেঙে ১৫টি দেশ হল।
  • দেশ হারালেন ক্রিকালেভ। কে ফেরাবে তাঁকে? এই সংশয় ক্রমেই দীর্ঘ করল বন্দিদশা।
Advertisement