বাংলা গানে যাঁর বিবর্তন আনার ঝড় নব্বই দশকে বিশাল বিতর্ক তৈরি করেছিল। রবীন্দ্রভারতী কাণ্ডে স্বয়ং তিনি কী বলছেন? কার দিকে? কবীর সুমনের কথা শুনলেন ইন্দ্রনীল রায়।
…প্রথমেই বলি, এই বিষয়ে আমার একটা সনির্বন্ধ অনুরোধ আছে। এই নবীনদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে কি, তাঁরা কেন এটা করেছেন? করা হয়নি তো? আমি একটা বাহাত্তর বছরের বুড়ো। আমি বাংলা খেয়াল নিয়ে আছি। আমার কাছে বাংলা খেয়াল শিখতে আসছেন কিন্তু শুধু নবীনরাই। তাঁদের বয়স ষোলো থেকে বাইশের মধ্যে। অন্তত দশ-বারোজন এই বয়সের নবীন বাংলা খেয়াল শিখবেন বলে আমার কাছে আসছেন। তাঁরা ছোট। আর আমি তাঁদের ছোট করতে রাজি নই। এই নবীনরা যখন কিছু করছেন, একবার জিজ্ঞেস করা যাক না, কেন তাঁরা করছেন? তাই না? আমি নবীনদের সম্মান করি। অন্তত প্রবীণরা যা খেল দেখিয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে…
রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি গান গ্রামোফোনে রেকর্ড করেছিলেন। আমরা যারা ‘রবীন্দ্রজীবী’ গায়ক-গায়িকা, আমরা ওই গানদুটিকে বা তিনটিকে তো ছেড়ে দিতে পারতাম। ওগুলো আমরা গাইব, ফাংশন করব, পয়সা নেব, সব করব, কিন্তু গ্রামোফোন রেকর্ড করব না। এটা তো ঠিক করতে পারতাম। কিন্তু আমরা করিনি। আমরা প্রত্যেকে, আমি তাঁদের নাম করছি না, তাঁরা গত হয়েছেন সব। তাঁরা মারা গিয়েছেন। তাঁরা কেউ ছেড়ে দেননি রবীন্দ্রনাথের ওই দু’তিনটি গানকেও- ‘তবু মনে রেখো’ আর ‘আমার শেষ পারানির কড়ি’। আমরা কেউ ছেড়ে দিইনি।
ইউরোপে কত অপেরা আছে। কোন আমল থেকে। কোনওদিন কেউ সেই অপেরাগুলোর সুর পালটে নতুন করে ছবি করেনি বা রেকর্ড করেনি। বা তার ইনস্ট্রুমেন্টেশনের ভঙ্গিটাকে, ধরনটাকে পালটায়নি। যেমন ভায়োলিনের জায়গায় পিয়ানো-অ্যাকর্ডিয়ন ঢোকেনি।
কিন্তু আমাদের এখানকার একজন ইন্টেলেকচুয়াল স্রষ্টা, তিনি ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্যটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দেড়শোতম জন্মবার্ষিকীতে ছবি করেন। নিজে সেখানে ‘এলেম নতুন দেশে’ গানটি করেন। আমি একটি গানই শুনেছি। তারপরে ঘেন্নায় আর কিছু শুনিনি। ‘এলেম নতুন দেশে’ গানের অংশে তিনি প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ করে হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন। এলেম নতুন দেশে… প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ। এবং ‘এলেম নতুন দেশে’র সুর পালটে গিয়েছে। আমি কিন্তু একবারও বলছি না নতুন সৃষ্টি হবে না। কিন্তু নিজে করুক না। রবীন্দ্রনাথের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কেন? নিজে করি না আমরা। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, এই যে রোদ্দুর রায় রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে খিস্তি বা কিছু অশালীন শব্দ ঢুকিয়েছেন, সেটা আপনি কীভাবে দেখছেন?
[ আরও পড়ুন: ‘ওরা তো নাশকতা করেনি, ওরা ওদের মতো’, রবীন্দ্রভারতী প্রসঙ্গে মুখ খুললেন রোদ্দুর রায় ]
আমি আবার বলছি। আমার ওকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, দোষ দেওয়ার আগে, এটা তিনি কেন করলেন? কেউ কি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছে? ওঁর দিকটা তো আমাদের জানতে হবে রে ভাই। খিস্তি অবশ্যই একটা জঘন্য জিনিস। কিন্তু আমার না খিস্তির থেকেও ‘এলেম নতুন দেশে’ শুনে বেশি রাগ হয়েছে। তাঁরা তো রবীন্দ্রনাথের গানটাকে জেনেশুনে তাঁর সুরটাকে পালটে, যা ইচ্ছে তাই করেছেন।
অথবা, এটা প্লিজ লিখবেন, ভদ্দরলোকের ছেলেরা, তারা সব লক্ষ লক্ষ টাকার সিনেমা বানিয়ে কী করেছেন? ‘পাগলা হাওয়ার… প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ… বাদল দিনে… প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ’। একজন বিখ্যাত কবি লেখেননি, ‘** মারি তোর শপিং মলের’? আজকে রবীন্দ্রনাথের গানের এটা হচ্ছে বলে আপনাদের এত অসুবিধে, তাই তো? তা রবীন্দ্রনাথের গান তো স্বয়ং ডি এল রায় ভেঙেছিলেন। সে তো রোদ্দুর রায় বা মেঘ রায় করেননি। সে তো মহর্ষিরা করে গিয়েছেন।
তাই রোদ্দুর রায় বা যে কেউ ভাল করছে না খারাপ করছে তা নিয়ে আমি ইন্টারেস্টেড নই। আমার কথাটা হচ্ছে রোদ্দুর রায় মহাশয়কে আমি নমস্কার জানিয়ে বলব, তিনি যদি অনুগ্রহ করেন আপনাদের পত্রিকায় লেখেন, কেন তিনি এটা করেছেন? যে চেঁচামেচি শুরু হয়েছে, রোদ্দুর রায় যিনিই হন, বা যাঁরা এটা করছেন, আমি শুধু চাই একটা সহজ-সভ্য সমাজ তাঁদের সঙ্গে কথা বলুক। একটা কথা হোক। একটা ডায়ালগ হোক। যখন একজন বাংলাদেশি লেখক বা লেখিকা হজরত মহম্মদকে নিয়ে খিস্তি করছিলেন, তখন সবাই রাস্তায় নামেননি কেন?
[ আরও পড়ুন: অজিতেশ অভিনীত চরিত্রে এবার রজতাভ, চ্যালেঞ্জ নিয়েই মঞ্চস্থ ‘শের আফগান’ ]
আর একটা কথা শুনছি। এটা কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে হল বলে। আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করতে চাই, ১৯৮৬ সালে হোপ ৮৬-এ কী হয়েছিল ভাই? যখন জনি ওয়াকার না জনি কে একটা এসে বলেছিল, আমি যা করি সব প্রেম করে করি, অব ম্যায়ঁ রেপ করুঙ্গা। মন্ত্রীদের সামনে বলেছিল তো এই কথাগুলো। কেউ তখন ওকে আটকেছিল?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই বামপন্থীরা কী খিস্তিটাই না করে। ‘কালীঘাটের ময়না’ অমুক তমুক। আমি মমতার দালাল বলে বলছি তো, বেশ করছি। এবারে নবীনরা কেন করছেন, আসুন তাঁদের জিজ্ঞেস করা যাক। তাঁদেরও লিখতে বলা যাক। তাঁদের মত তাঁরা জানান…
The post ‘দোষ দেওয়ার আগে জানতে চাই, এটা তিনি কেন করলেন?’, রোদ্দুর রায় প্রসঙ্গে কবীর সুমন appeared first on Sangbad Pratidin.