স্কিন ডিজিজে একই ওষুধ টানা লাগিয়ে যাচ্ছেন? অধিকাংশই নিজের ডাক্তারি নিজে করতে গিয়ে এই ভুলটা করেন। এতে সাময়িক উপশম হলেও, ওষুধ বন্ধ করলেই তা আরও বাড়ে। ত্বকের ব্যাপারে এই উদাসীনতা ঠিক নয়। কেন? ব্যাখ্যা করলেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ডার্মাটোলজিস্ট ডা. অভিষেক দে। শুনলেন কোয়েল মুখোপাধ্যায়।
ত্বকের সমস্যা দূর করতে মাখছেন স্টেরয়েড ক্রিম, ওষুধ। কিন্তু সেই ওষুধেরই বেলাগাম, বেঠিক প্রয়োগে ঘনিয়ে আসছে বিপদ। সমস্যার সমাধান তো হচ্ছেই না, বরং অবাঞ্ছিত নতুন বিপদের মোকাবিলা করতে গিয়েও মাথার ঘাম ফেলতে হচ্ছে পায়ে। কেন? ভুলটা ঠিক কোথায় হচ্ছে? জেনে নিলে, বিপর্যয় এড়াতে পারবেন অনেক সহজে।
এক ওষুধে সব কাজ হয় না ত্বকে স্টেরয়েডের অযাচিত প্রবেশ মূলত তিনভাবে
হতে পারে। এক, কোনও শারীরিক সমস্যার (ধরা যাক র্যাশ-চুলকানি) সমাধানের জন্য হয়তো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ কোনও একটি স্টেরয়েড-ধর্মী ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছিলেন। নির্দিষ্ট মেয়াদ, ধরা যাক স্রেফ ২-৩ সপ্তাহের জন্য। সেই ওষুধের প্রয়োগে সমস্যার সমাধান হতে, রোগীর মনে হতে পারে– এর পর থেকে যখনই ওই সমস্যা দেখা দেবে, তিনি ওই ওষুধটিই লাগাবেন। যত দিন খুশি। এই প্রবণতাটিই ভুল। এর ফলে যে ওষুধ নির্দিষ্ট রোগের জন্য সঠিক ওষুধ ছিল, সেটাই ওই-জাতীয় অন্য রোগের জন্য, ভুল মেয়াদে ব্যবহার হওয়ার ফলে ভুল ওষুধ হয়ে গেল।রোগীকে বুঝতে হবে– ত্বকের বিভিন্ন রকমের রোগের জন্য বিভিন্ন রকমের ওষুধ আছে। একটি স্টেরয়েড-জাতীয় ক্রিম বা মলম পৃথিবীর সমস্ত ত্বকের রোগ সারাতে পারে না। আর একই ওষুধ প্রত্যেকবার কাজ করবে, সেটাও হতে পারে না। এটা হল প্রথম ভুল।
দ্বিতীয় ভুল, ফাঙ্গাসজনিত রোগের জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা উচিত নয়। অ্যান্টি-ফাংগাল ওষুধ, যা ডাক্তারবাবুরা দিয়ে থাকেন, সেটাই ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু বাজারে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহু ওষুধ পাওয়া যায়, যা আদপে নানা ধরনের স্টেরয়ডের কম্বিনেশন ওষুধ। ‘ককটেল’ ওষুধ বলা যায়। কোনও সতর্কতা ছাড়াই, পাড়ার ওষুধের দোকানগুলিতে পাওয়া যায়। লোকজনও দোকানে গিয়ে, সমস্যা জানিয়ে বাজারচলতি কিছু একটা কিনে লাগাতে শুরু করেন। ফলে হিতে বিপরীত হয়। আবার, ব্রণ, দাদ, মেচেতার কালচে ছোপ, ত্বকে খুশকির মতো চামড়া ওঠার সমস্যাতেও অনেকে বাজারচলতি স্টেরয়েড ক্রিম মাখেন।
এটা ঠিক নয়। আপনার ত্বকের সমস্যা একজিমা না ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন, সেটা আগে খতিয়ে দেখে নিয়ে, চিকিৎসা সেই অনুযায়ী হওয়া উচিত। কোয়াড্রিডাম, পেন্টাড্রাম এই ধরনের অজস্র ‘মিক্সচার’ ওষুধের লাগাতার সেবনে ত্বকের সমূহ ক্ষতি হয়। মাখতে মাখতে ত্বক ‘স্টেরয়েড ডিপেন্ডেন্ট’ হয়ে যায়। এ দেশে স্টেরয়ডের বহুল প্রয়োগে দুই শ্রেণির রোগ-ব্যধি দেখা যায়। এক, ট্রপিক্যাল স্টেরয়েড ডিপেন্টেড ফেস। আর দুই,
ট্রপিক্যাল স্টেরয়েড ডিপেন্টেন্ড গ্রয়েন। অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহারে ‘স্টেরয়েড অ্যাডিকশন’ বা নেশার শিকারও অনেকে হতে পারেন।
তৃতীয় ভুল, ফর্সা হওয়ার আকুলতা। বিজ্ঞাপনী প্রচার যার অনুঘটক। এই মারাত্মক প্রবণতার কারণে প্রচুর মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা ফেয়ারনেস ক্রিমে আসক্ত। অথচ এগুলোর বেশিরভাগই শুধু ‘স্ট্রং’ স্টেরয়েড নয়, আরও অনেক ক্ষতিকারক জিনিস দিয়ে তৈরি হয়। বহুল প্রয়োগে ত্বকের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়। একাধিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
[আরও পড়ুন: হানিমুনে পাহাড়ে? সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে শীতল বিছানায় কীভাবে ছড়াবেন উষ্ণতা? রইল টিপস ]
ত্বকে ফুটে ওঠে ‘চাঁদের কলঙ্ক’
ফর্সা হওয়ার বাজার-চলতি ক্রিম, যা কড়া মাত্রায় স্টেরয়েড দিয়ে তৈরি, মেখে ত্বকে বীভৎস পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। মুখে ব্রণ হয়, কালো-বাদামি ছোপ ছোপ দাগ ওঠা থেকে শুরু করে পুঁজ জমা বা ক্রাস্টিং পর্যন্ত হতে পারে, চামড়া পাতলা হয়ে যায় অসম্ভব রকম-এতটাই যে লাল হয়ে রক্তনালি ফুটে ওঠে, মেয়েদের মুখে অবাঞ্ছিত রোম-দাড়ি গজিয়ে ওঠে, চামড়া গর্ত হয়ে যায়। এছাড়াও ‘রোজেশিয়া’ বলে এক ধরনের সমস্যা হতে পারে, যেখানে ত্বক অতিরিক্ত মাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়ে।
অতিরিক্ত কেমিক্যাল যুক্ত সাবানে, ফর্সা হওয়ার বেশ কিছু ক্রিমে হাইড্রোকুইনান থাকে। এটা মেলাজমা সারানোর ওষুধ। কিন্তু অতি-ব্যবহারে ‘ওক্রোনোসিস’ হতে পারে। অর্থাৎ চামড়ার মধ্যে মাটির মতো আস্তরণ জমতে থাকে। ফলে তা দাগ-ছোপে ভরে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর কোনও চিকিৎসা নেই। দামি দামি লেজার প্রয়োগেও সারে না।
‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের থেকে দূরে থাকুন
সাধারণ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। চেষ্টা করুন, গরমকালে সুতির জামাকাপড় বেশি পরতে।
ত্বকের সমস্যার ওষুধকে ওষুধ হিসাবেই দেখুন। সঠিক ওষুধ, সঠিক মাত্রায়, সঠিক মেয়াদে এবং সঠিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে তবেই লাভ। কিন্তু সেটাই যদি অন্য রোগে, অন্য মাত্রায়, অন্য মেয়াদে এবং অন্যভাবে প্রয়োগ করেন, ক্ষতি অনিবার্য। ওষুধটি যে স্টেরয়েড-যুক্ত, তা ওষুধের টিউবের একপাশে লেখা থাকে। কিন্তু এইটুকু সতর্কতায় কাজ হবে না। এর অবাধ ব্যবহারে লাগাম পরাতে সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। নজরদারি দরকার। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওষুধের দোকানগুলিতে, যে কেউ যা খুশি যাতে বিক্রি করতে না পারেন, তার জন্য কঠোর ‘ফার্মাসি নজরদারি’ দরকার।
অনলাইনে তো আরও ‘স্বাধীনতা’। কোনও প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বেলাগাম বিক্রি হয়। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। ইউটিউবার-ইনফ্লুয়েন্সারদের দৌরাত্ম্য আজ মারাত্মক। অনেক স্বঘোষিত ‘হেলথ’ ইউটিউবার তাঁদের ভিডিওয় যেমন খুশি স্টেরয়েডের নাম বলেন, ‘গ্যারান্টি’ দেন যে মাখলেই ফর্সা হয়ে যাবে-উজ্জ্বলতা বাড়বে-ত্বকের দাগ ছোপ কমে যাবে। আর মানুষ চোখ-কান বুজে তা অনুসরণ করে। এই জিনিস অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ডাক্তারদেরও এগিয়ে আসতে হবে।