বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল নিয়ে পারদ চড়েছে টেমসের পারে। অস্ট্রেলিয়া (Australia) যথারীতি কলার-তোলা হাবভাব নিয়েই রয়েছে। কিন্তু গুরু গ্রেগ বলছেন, জয়ের পথে কাঁটা হতে পারেন বিরাট কোহলি (Virat Kohli), শুভমান গিল (Shubman Gill )। কোন কোন দিকে নজর দিতে হবে নিজের দেশকে, ভারতই বা এগিয়ে কোন দিকে? দীর্ঘ আলাপচারিতায় মনের ঝাঁপি উজাড় করলেন গ্রেগ চ্যাপেল (Greg Chappell), ‘গুরুবচন’ শুনলেন বোরিয়া মজুমদার ও রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়।
শেষ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে ভারত খেলতে গিয়েছিল লকডাউন আর অর্ধেক আইপিএল খেলে। নিউজিল্যান্ড সেখানে ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ খেলে বিলেতে পড়ে ছিল। এবার একমাত্র চেতেশ্বর পুজারাকে বাদ দিলে বাকি ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই যাচ্ছেন দু’মাসের আইপিএল খেলে। সাধারণত আইপিএল দু’মাস ধরে চলে। মে আর জুন মাস ধরে। আর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল সব সময় হয় জুনে। তা হলে ভারত কি কোনও দিনই যথেষ্ট প্রস্তত হয়ে টেস্ট ফাইনালে নামতে পারবে না?
গ্রেগ: আমার মনে হয় না, অস্ট্রেলীয়রাও দারুণ কিছু প্রিপেয়ার করে আসছে বলে। প্রস্তুতির দিক থেকে দেখলে ভারত আর অস্ট্রেলিয়া–দু’টো টিম একই অবস্থায় থাকবে। আর যদি সেটাকে প্রস্তুতির অভাব বলেন, তাতেও দু’টো টিম একই জায়গায়। আর মনে করার কোন কারণ নেই যে, ইংল্যান্ডে খেলা বলে প্রথম বল থেকে অস্ট্রেলিয়া সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করবে। ইংল্যান্ডের পেসারদের কথা আলাদা। ব্রড-অ্যান্ডারসন কিন্তু জানে, দেশের পিচ থেকে ফায়দা কী ভাবে তুলতে হয়। সেখানে অস্ট্রেলীয় পেসারদের বুঝতে সময় লাগবে পিচটা কেমন। আর তাই আমি কোনও ভাবে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে পিছিয়ে ভারতকে রাখতে পারব না। আমি বলব, সমান-সমান যুদ্ধ হবে। আর আইপিএল? আমরা সবাই জানি যে, টেস্ট ক্রিকেট সম্পূর্ণ আলাদা। যে পরিবেশে খেলা হবে, সেটাও আলাদা। মানছি, ভারতীয়দের একটু মানিয়ে নিতে হবে। অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে ওরা যথেষ্ট অভিজ্ঞ। কী করা উচিত, ওরা জানে। মানসিক ভাবে টেস্টের জন্য ‘সুইচ অন’ করাটা সবচেয়ে জরুরি।
আপনি আপনার প্রথম সফরে জুনের ওভালে একটা টেস্ট খেলেছিলেন। বড় রান করেননি। কিন্তু পরে লর্ডস আর সেই ওভালেই সেঞ্চুরি করেছিলেন। কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল? জুন মাসের ইংল্যান্ডে ভাল ব্যাট করতে গেলে কী করা উচিত?
গ্রেগ: ব্যাটারকে সবার আগে স্বীকার করতে হবে যে, আমাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে ইংল্যান্ডের পরিবেশ। সব সময়। সেটা রোহিত-বিরাটের ক্ষেত্রে যেমন হবে, তেমনই স্মিথ-ওয়ার্নারের ক্ষেত্রেও হবে। মনে রাখা দরকার, দু’টো টিমেই দুর্ধর্ষ সব বোলার রয়েছে। যারা ওই পরিবেশে ব্যাটারের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করবেই। অস্ট্রেলীয় উইকেটের সবচেয়ে কাছাকাছি পিচ আপনি পাবেন ওভালে। বাউন্স থাকবে পিচে। ব্যাটারকে সেটা সামলাতে হবে। পেসার নিজের ছন্দে থাকলে যথেষ্ট মুশকিলেও পড়তে হবে ব্যাটারকে। আর এক একটা সময় সেটা করবেও বোলার। ব্যাটারকে লাগাতার ঝামেলায় ফেলে যাবে। আমার মতে, সেই টাফ পরিস্থিতি সামলানোর মানসিক জোর দেখাতে হবে ব্যাটারকে। আবার একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, টেস্টে আপনি বাঁচার ক্রিকেট খেলে নিস্তার পাবেন না। আপনাকে প্রতিটা সুযোগের ফায়দা তুলতে হবে, রান করতে হবে। আর তাই মানসিক ভাবে ব্যাটারের ভাল জায়গায় থাকা দরকার। ওয়ার্নারের ব্যাপারটাই ধরুন। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ড সফরে ওর ব্যর্থতা নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছিল। কিন্তু ওয়ার্নার সমস্যায় পড়েছিল ব্রড-অ্যান্ডারসনকে খেলতে গিয়ে। যারা কি না ওই পরিবেশের ফায়দা তুলতে সবচেয়ে ভাল জানে। কিন্তু ভারতীয় বোলাররা যদি একটুও ভুলচুক করে, ওয়ার্নারের ক্ষমতা আছে মেরে দেওয়ার, অস্ট্রেলিয়াকে ভাল একটা শুরু দেওয়ার। বললাম না, দু’টো টিমের প্লেয়ারদের মানসিক লড়াইটা দেখার মতো হবে।
শুভমান গিল নিয়ে একটু বলুন। কতটা ভাল লাগছে আপনার গিলকে?
গ্রেগ: খুব ভাল প্লেয়ার। টেস্ট ক্রিকেটে ভাল করার সব রকম ক্ষমতা ওর রয়েছে। ভারত একটা ভাল কাজ করেছে। সেটা হল প্লেয়ারদের বিদেশে বারবার পাঠিয়ে সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে সহজাত করে দিয়েছে। যার ফলে প্লেয়ারদের গুণগত মানের অনেক উন্নতি হয়েছে। গিল কিন্তু ইতিমধ্যে ৭৫-টা লিস্ট এ ম্যাচ খেলে ফেলেছে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছে। অর্থাৎ, সে দিক থেকে দেখলে বাইশ বছর বয়সেই ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। প্লাস, গিল আইপিএলে দুর্ধর্ষ ফর্মে ছিল। সেটা যে কাউকে বিশাল আত্মবিশ্বাস দেবে, আর গিলও ব্যতিক্রম নয়। তবে ইনিংস শুরুর সময় ও দু’একটা জিনিস করে, যা আমি খেয়াল করেছি। আমি নিশ্চিত অস্ট্রেলিয়া টিমও করেছে। সে সব বলব না। কিন্তু স্টান্স নেওয়ার সময় ও এমন কিছু জিনিস করে, যা অস্ট্রেলিয়া বোলারদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
একটা কথা বলুন। আইপিএলে রোহিত-বিরাট-রাহানেদের প্রায় বল পিছু চার-ছয় মারতে হয়েছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের টেস্ট ফাইনালে তিনটে বল খেললে দু’টো ছাড়তে হবে। মানসিকই বলুন না টেকনিক্যাল–কতটা অ্যাডজাস্টমেন্ট দরকার?
গ্রেগ: টেস্ট ক্রিকেট তো চ্যালেঞ্জিং হবেই, তাই না? কিন্তু এরাও এত দিন ধরে খেলছে। কী করে অ্যাডজাস্ট করতে হবে, সেটা জানা উচিত। আর একেবারে ক্রিকেট না খেলার চেয়ে কিছুটা ক্রিকেট খেলা ভাল। অ্যাডজাস্টমেন্টটা করতে হবে মানসিক ভাবে। ক্রিকেট চেতনায়। জুনের শুরুতে ইংল্যান্ডে খেলা সহজ নয়। তার কিছু নিজস্ব দাবি থাকে। আমি নিশ্চিত, ওরা প্রস্তুত হয়ে আসবে।
বিরাট আর রোহিত, দু’জনেই গ্রেট প্লেয়ার। কিন্তু বিরাট অস্ট্রেলিয়ায় যতটা সফল, ইংল্যান্ডে ততটা নন। আবার রোহিতের আইপিএল ভাল যায়নি। কী মনে হয়, টেস্ট ফাইনালে এর প্রভাব পড়বে?
গ্রেগ: ২০১৪ আর ২০২১ সালের ইংল্যান্ড সফরে বিরাটকে প্রবল ভুগিয়েছে অ্যান্ডারসন, ব্রড। দুর্ধর্ষ লেংথে বল করেছে ওরা। ওরা জানত যে, বিরাট সেরা ব্যাটার। তাই ওরাও নিজেদের সেরাটা দিয়েছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াও যে প্রথম বল থেকে একই জিনিস করবে, ভাবাটা ভুল। ইংরেজরা নিজেদের পরিবেশকে সবচেয়ে ভাল জানে। বিরাট আবার ভালবাসে অস্ট্রেলীয়দের খেলতে। আমার মতে, ওভালের যা বাউন্স, তাতে বিরাটের পছন্দ হবে। ওভালের পিচের চরিত্র অস্ট্রেলীয় পিচের কাছাকাছি। আর সেটা বিরাটের পছন্দ হবে।
আর রোহিত? আইপিএল পুরো আলাদা। তাছাড়া আমরা রোহিতের ফর্ম নিয়ে কী ভাবছি, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ও নিজে কী ভাবছে? প্রশ্ন হল ও কি নিজেকে নিয়ে সংশয়ে ভুগছে? নাকি বিশ্বাস রাখছে যে, আমি ঠিক পারব? দ্বিতীয়টা হলে, ওর ভাল ব্যাট করা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এটা ঠিক যে, বোলার ওকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। কিন্তু সেটা সবার ক্ষেত্রেই হবে। আইপিএলে যদি ও মানসিক ভাবে ভাল অবস্থায় থাকে, ফর্ম কোনও ব্যাপার না। (চলবে)