সব্যসাচী বাগচী: মাঝেমধ্যে মনে হয় অনুষ্টুপ মজুমদারের (Anustup Majumdar) মধ্যে দ্বৈত সত্ত্বা কাজ করে। প্রথম জন, মিতভাষী, লাজুক স্বভাবের। মুখে একগাল হাসি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। আর দ্বিতীয় জন, ঠিক যেন স্টিভ ওয়ার ‘ক্লোন’। যিনি দলের একজন নীরব যোদ্ধা। আগ্রাসী মেজাজের ব্যাটিং করে বিপক্ষকে উড়িয়ে দেন। দলে চাপে পড়লেই ধরা দেন ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবে। তবে বয়স অনুপাতে নিজের ঝুলিতে রান আরও বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেন কোথায়!
চলতি বিজয় হাজারে ট্রফিতে (Vijay Hazare Trophy) অনুষ্টুপ বরাবরের মতো আগ্রাসী মেজাজে ধরা দিচ্ছেন। পাঞ্জাবের (Punjab) বিরুদ্ধে চাপের মুখে ১১১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন রুকু। সেটা ছিল তাঁর লিস্ট এ ক্রিকেটে ষষ্ঠ শতরান। শনিবার, ৯ ডিসেম্বর গুজরাটের (Gujarat) বিরুদ্ধে নক আউট পর্বের আর এক ম্যাচে দলের মান বাঁচালেন অভিজ্ঞ অনুষ্টুপ। এই সুবাদে লিস্ট এ ক্রিকেটে সেরে ফেললেন সপ্তম সেঞ্চুরি। ৮৮ বলের ১০২ রানের এই ইনিংসে অনুষ্টুপ মারলেন ১০টি চার ও ১টি ছক্কা। আগামী ১১ ডিসেম্বর হরিয়ানার বিরুদ্ধে শেষ আটের ম্যাচে নামবে বাংলা। এর আগে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলেই রাজকোট থেকে সংবাদ প্রতিদিন.ইন-কে টেলিফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন ৩৯ বছরের বঙ্গ ব্যাটার।
প্রশ্ন) আপনি যে স্তরের ক্রিকেটার, তাতে রানের নিরিখে অনেকের থেকে পিছিয়ে গেলেন! মন খারাপ হয়?
অনুষ্টুপ) হ্যাঁ এটা ঠিক যে ২০-২৩ বছরের মধ্যে কোনও ব্যাটার ভালো পারফর্ম করলে, তাঁর কাছে এগিয়ে যাওয়ার দরজা আরও খুলে যায়। আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। তাই খারাপ লাগার কোনও জায়গাই নেই। আমি নিজেও তখন ভালো খেলিনি, সেটা তো সত্যি। আর পারফর্মারদের চাপ তো নিতেই হবে। বয়স যত বাড়বে, প্রত্যাশা বাড়বে, চাপও বাড়বে পাল্লা দিয়ে। আর আমার কেন জানি না মনে হয়, চাপে আমার খেলা খোলে বেশি। ওটাকেই এখন বেশি উপভোগ করি।
প্রশ্ন) এই বয়সে নিজের ফিটনেস কীভাবে ধরে রাখছেন?
অনুষ্টুপ) ক্রিকেট আমার প্রথম প্যাশন। সেটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করে। সবাই জানি গোটা বছর ধরে ক্রিকেট খেলতে গেলে ফিটনেস ধরে রাখা কতটা জরুরি। কারণ একটা-দুটি ম্যাচে কোনও ব্যাটার রান না করতেই পারে, কিন্তু ফিটনেস নিয়ে একবার প্রশ্ন উঠে গেলেই কিন্তু সব শেষ! আমি বেশিদিন হয়তো খেলব না। এখনও খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। তবে যতদিন খেলব, নিজেকে পুরো ফিট রেখেই খেলব। যাতে কেউ আমার ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন না তুলতে পারেন।
প্রশ্ন) কীভাবে নিজের ফিটনেস ম্যানেজ করেন?
অনুষ্টুপ) শুধু জিম নয়, মেন্টাল ফিটনেস ও পরিমিত খাবারের দিকে অনেক বেশি নজর দিচ্ছি। কারণ আমার বয়স তো আর ২৫ নয়। তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে দমে পাল্লা দিতে হলে নিজেকে তো ধরে রাখতেই হবে। তবে বেশি রানিং করি না। জিম করতেই ভালোবাসি।
[আরও পড়ুন: অধিনায়ক সুদীপ-অনুষ্টুপের জোড়া সেঞ্চুরি, গুজরাটকে হেলায় হারিয়ে শেষ আটে বাংলা]
প্রশ্ন) ভালো পারফরম্যান্সের জন্য মেন্টাল ফিটনেসের দিকটাও জরুরি। সেই কাজটা কীভাবে বছরের পর বছর ধরে করছেন?
অনুষ্টুপ) কেরিয়ারের শুরু থেকেই প্রতি ট্যুরে বই আমার সঙ্গী। বই আমাকে শান্তি দেয়। রাতে হোটেলে ফিরে বই পড়লে খুব ভালো ঘুম আসে। যেটা ভালো খেলার জন্য খুব দরকার। যখন বয়স কম ছিল তখন ফেলুদা কিংবা অন্যান্য রহস্য-রোমাঞ্চ বই পড়তাম। তবে বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে একটু আলাদা ধরনের বই পড়তে খুব ইচ্ছা আছে। কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে মাথা ঠান্ডা রাখা উচিত, কীভাবে ব্রেনে আরও বেশি অক্সিজেন যাবে, সেগুলোর জন্য মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর বই পড়ি। এছাড়া মানসিক জোর বাড়ানোর জন্য স্বামী বিবেকানন্দের বই তো আছেই।
প্রশ্ন) পরপর দুটি সেঞ্চুরি। পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে ১১১ রানের পর, এবার গুজরাটের বিরুদ্ধে অপরাজিত ১০২ রান। কোন ইনিংস বেশি কাছের?
অনুষ্টুপ) গুজরাটের বিরুদ্ধে চেজ করে জিতলেও, আমার কাছে পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরিটাই সেরা। কারণ সেই উইকেট অনেক বেশি কঠিন ছিল। তাছাড়া আমরা দ্রুত অলআউট হয়ে গেলে এই জায়গায় তো আসতেই পারতাম না। সেই তুলনায় রাজকোটের উইকেটে ব্যাট করা অনেক সহজ। তাই অক্ষর প্যাটেলকে দেখে খেলেই এল সাফল্য।
প্রশ্ন) শেষবার ২০১১-১২ মরশুমে বিজয় হাজারে ট্রফি জিতেছিল বাংলা। সেই দলের অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অনেক বছর আগেই অবসর নিয়েছেন। লক্ষীরতন শুক্লা আপনাদের কোচ। সেই দলের বাকিরা অনেকেই খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ আপনার ইনিংস কিন্তু চলছেই। এর পিছনে রহস্য কী?
অনুষ্টুপ) আমার মনে হয় পারফরম্যান্সই শেষ কথা। আমি যে বয়সে পৌঁছে গিয়েছি, তাতে যদি কয়েকটি ম্যাচে রান না পাই তাহলে কথা উঠবেই। কাউকে কথা সুযোগ দিতে আমি রাজি নই। ফিটনেস অবশ্যই এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাছাড়া সেই ২০০৪ সাল থেকে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সুবাদে কোন মাঠের উইকেট কেমন হতে পারে সেই বিষয়ে ধারণা আছে। সঙ্গে রয়েছে মেন্টাল ফিটনেস। বড় ম্যাচে মেন্টাল ফিটনেস বজায় রাখতে পারলে, অনেক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়।
প্রশ্ন) পরিবারও আপনাকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে।
অনুষ্টুপ) অবশ্যই। বাবা, মা, ছেলে পোপ, স্ত্রী সোনালি আমাকে বছরের পর বছর ধরে অক্সিজেন জুগিয়ে চলেছে। ওদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বাংলা ছেড়ে রেলওয়েজে চলে যাওয়া, কিংবা রেলের চাকরি ছেড়ে আবার বাংলায় ফিরে আসার সময় আমার পরিবার পাশে দাঁড়িয়েছিল। পরিবার পাশে না থাকলে অনেক আগেই খেই হারিয়ে ফেলতাম।
প্রশ্ন) এই ম্যাচে অবিচ্ছেদ্য ২০৯ রানের জুটি সব হিসেব বদলে দিয়েছে? সুদীপ ঘরামির সঙ্গে জুটি কেমন ছিল?
অনুষ্টুপ) খুব ভালো অভিজ্ঞতা। সুদীপ খুব ভালো ব্যাট করেছে। অনেক দিন পর রান পেল। সেটা দেখে ভালো লাগছে। আগেও বলেছি আবার বলছি অক্ষর প্যাটেলকে দেখে খেলতেই ম্যাচ আমাদের দিকে ঢলে পড়েছিল। অবশ্য বোলারদেরও তারিফ করতে হবে। কারণ এমন ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে ২৮৩ রানে বিপক্ষকে রুখে দেওয়া কিন্তু জলভাত নয়। তবে এই ম্যাচে জয় নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সামনে আরও কঠিন লড়াই। তাই বিপক্ষ দল নিয়ে এখন থেকেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছি।