সুমন ভট্টাচার্য: মা অন্ধকার ঘরে একলা খাটের উপর বসে অঝোরে কাঁদছে। আর বাবা জানলার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ছোটবেলার এই দৃশ্যটা আজও আমার মাথায় গেঁথে আছে। সেদিন আমি বুঝতে পারিনি, একটা সিনেমা দেখার অভিঘাতে মা কেন কাঁদছিল। বাবা কেন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
‘আদালত ও একটি মেয়ে’ মুক্তি পায় ১৯৮২ সালে। তপন সিনহার সিনেমা বলে মা আর বাবা বোধহয় প্রথম সপ্তাহেই দেখতে গিয়েছিল। আর সিনেমা দেখার অভিঘাতটা ছিল তীব্র। বেশ পরে জানতে পেরেছিলাম, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’এর বিষয়: গণধর্ষণ। ক্লাস থ্রি-র মস্তিষ্ক দিয়ে আমি তখন বুঝতে পারিনি, গণধর্ষণ আসলে কী। কিন্তু, এটুকু বুঝে গিয়েছিলাম যে, এমন একটা বিষয়, যা পর্দায় দেখলে বা অন্য কোথাও পড়লেই মার কান্না বাগ মানে না।
[আরও পড়ুন: আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কি নেতিবাচক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী? ]
এখন, আমার ৪৮ বছর বয়সে, আমার তরুণী-কন্যা যখন ‘নেটফ্লিক্স’-এ ‘আনবিলিভেব্ল’-এর মতো ওয়েব সিরিজ দেখে গম্ভীর মুখে বসে থাকে, খেতে চায় না, তখন বুঝি আসলে সময়টা বদলেছে মাত্র। অভিঘাত একই আছে। এটা কিন্তু শুধু একজন নারী যখন পর্দায় আরেকজন নারীকে অত্যাচারিত হতে দেখছে, তার অভিঘাতটুকু। আর, যে ধর্ষিত হচ্ছে? শুধু ভাবলেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। তাই হাথরাসের দলিত মেয়েটির চিতায় জ্বলে যাওয়ার ভিডিওটা যতবার দেখি, শিউরে উঠি। ঠিক যেমন, এখনও আমি ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ সাহস করে দেখে উঠতে পারিনি। মায়ের ডুকরে-ডুকরে কান্না মনে পড়ে যায়। সেই রাতে মা আমাকে বুকের মধ্যে চেপে ঘুমিয়েছিল, তা মনে পড়ে যায়। মায়ের মাথার জবাকুসুম তেলের গন্ধ আর চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে আসা জল সবকিছু আবছা করে দেয়। আমার মেয়ে দেখার পরে আমিও যখন ‘নেটফ্লিক্স’-এ ‘আনবিলিভেব্ল’ দেখলাম, এবং আমেরিকার মতো দেশে একজন ধর্ষিতাকে কী কী সহ্য করতে হয়- তা আবারও টের পেলাম, তখনও আশপাশে সবকিছু ঝাপসা লাগে। শীত এখনও আসেনি জেনেও পাশের ঘরে শুয়ে থাকা মেয়ের গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে আসি। হাথরাস (Hathras) মেয়েটির বাবা তাহলে কী করবে ভাবুন? মাঝরাতে উঠে কাকে খুঁজবে? আমার মা একটা সিনেমা দেখে, আমার মেয়ে একটা ওয়েব সিরিজ দেখে ভয় পেয়েছে। ওঁরা তো চোখের সামনে সবকিছু ঘটতে দেখেছেন। এবং নিজেদের মেয়েকে ছাই হিসেবেও ফেরত পাননি!
আমার কাছে কলকাতার অনেক দ্রষ্টব্যের মধ্যে যেমন পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে মাইকেল মধূসূদন দত্তর কবর, তেমনই ভবানীপুরে সুজেট জর্ডনের সমাধিও। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে ধর্ষিতা সুজেট জর্ডন মৃত্যুর আগে অনেক কিছু প্রমাণ করে দিয়ে গিয়েছেন। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’-র উর্মিলা যেমন সবসময় সুবিচারের দাবি করতেন, তেমনই সুজেটও তাঁর উপরে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার চেয়েছিলেন। সুজেট জর্ডনের ধর্ষণের পরে সেই অন্যায়ের শাস্তি চাওয়ার মধ্যে যেমন কোনও অন্যায় ছিল না। তেমনই হাথরাসের ১৯ বছরের দলিত মেয়েটির উপর হওয়া অত্যাচারেরও ন্যায়বিচার চাই। চাই-ই চাই। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড যেমন ভারতকে নড়িয়ে দিয়েছিল, মহিলাদের সুরক্ষার প্রশ্নটিকে কীভাবে দেখা হবে, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের মোকাবিলায় কী করা উচিত- সেসব বিষয়কে সামনে এনেছিল। এবারও হাথরাসের দলিত তরুণীর হত্যা হয়তো আমাদের সবাইকে আরও সচেতন ও সক্রিয় হতে বাধ্য করবে। রাষ্ট্রকে, সমাজকে নতুনতর ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেবে। কারণ সেটাই মানবিকতা।
[আরও পড়ুন: মধ্যস্বত্বভোগীদের মৌচাকে ঢিল, লাইসেন্স-রাজ খতম করবে কৃষি বিল]
আর যদি রাষ্ট্র বা সমাজ সতর্ক না হয়? আমরা যদি এই নারকীয় ঘটনা থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখি? দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা হয়? তপন সিনহার ওই আইকনিক সিনেমায়, যাকে আজকের নারীবাদীরা ‘মাইলফলক’ বলেন, সেই জাতীয় পুরস্কার-বিজয়ী ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ চলচ্চিত্রে একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। ঠ্যাঙাড়ে গোবিন্দ। পরিচালকের অন্যতম প্রিয় অভিনেতা মনোজ মিত্র ওই ‘ঠ্যাঙাড়ে গোবিন্দ’-র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। যিনি প্রথম থেকে ধর্ষিতা তরুণীটির বিষয়ে সমব্যথী এবং চিনে ফেলেন সমাজের কোন উঁচু মাথারা এই ধর্ষণের ঘটনাকে আড়াল করতে চাইছেন।
ঠ্যাঙাড়ে গোবিন্দ সবসময় ঠিক আইনের বই পড়ে ধর্ষকদের শায়েস্তা করতে চাইতেন না। তপন সিনহা তবু শেষ পর্যন্ত আইনের পথেই ন্যায়বিচার দর্শিয়েছিলেন। কিন্তু, আজ যদি আমরা ভুল করি? ঠ্যাঙাড়ে গোবিন্দরা অন্য চেহারা ধরে, তেলেঙ্গানার পুলিশ (Telangana police) -এর মতো ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’-এর ভূমিকায় ফিরে আসবে না তো?