রঞ্জন মহাপাত্র, কাঁথি: সৈকত শহর দিঘা যেন দিনদিন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে। ভারতবর্ষের অপরাধীরা আত্মগোপন করার শ্রেষ্ঠ জায়গা হিসেবে দিঘাকেই কেন বারবার বেছে নিচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বেঙ্গালুরুর (Bangalore) রামেশ্বরম ক্যাফে বিস্ফোরণের দুই মাস্টারমাইন্ড এখান থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর। সৈকত শহরের নিরাপত্তা নিয়েও জোরদার প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি কুখ্যাত অপরাধী দিঘার (Digha) হোটেলে আত্মগোপন করার খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন পর্যটকেরা।
দিঘার এই হোটেলেই লুকিয়ে ছিল বেঙ্গালুরু বিস্ফোরণকাণ্ডে ধৃত ২ জঙ্গি। নিজস্ব ছবি।
সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে, ১ মার্চ বেঙ্গালুরুর রামেশ্বরম ক্যাফেতে যে আইইডি (IED) বিস্ফোরণ হয়েছিল, তাতে আহত হয়েছিলেন কমপক্ষে ১০ জন। ৩ মার্চ তদন্তভার গ্রহণ করে এনআইএ। তদন্তে নেমে সিসিটিভি (CCTV) ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, এক যুবক কালো রঙের ব্যাগ নিয়ে এসেছিল। মুখে মাস্ক পরা ছিল। ওই যুবক ইডলি অর্ডার করে। খাবার খেয়ে সে বেরিয়ে যায়। টেবিলের নীচে রেখে যায় ব্যাগটি। মিনিট দশেক পরই ক্যাফেতে বিস্ফোরণ (Blast) হয়। ঝলসে যান অনেকে। ওই হামলায় মূল অভিযুক্ত ছিল আবদুল মাথিন ত্বহা ও মুসাভির হুসেন শাহজেব। বিস্ফোরণের পর থেকেই সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলাচ্ছিল এনআইএ। কিন্তু তদন্তকারীদের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করার জন্যে একটার পর একটা রাজ্য পরিবর্তন করে।
[আরও পড়ুন: আচমকাই অলিম্পিকে ভারতের বড়সড় দায়িত্ব ছাড়লেন মেরি কম, কেন এই সিদ্ধান্ত?]
এনআইএ (NIA) সূত্রের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রথমে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় একাধিক হোটেলে আশ্রয় নেয়। তার পর দুজনে নাম পরিবর্তন করে গত সোমবার, ৮ তারিখ নিউ দিঘার এন ২ সেক্টরের একটি বেসরকারি হোটেলের দোতলার রুম ভাড়া নেয়। জানা গিয়েছে, দুজনেই ভুয়ো আধার কার্ড জমা দিয়ে হোটেল রেজিস্টারে নাম লিপিবদ্ধ করে। মুসাভির হুসেন শাহজেব ভুয়ো আধার কার্ডে নিজের নাম পরিবর্তন করে মহম্মদ জুনেইত রাখে। এই নামেই হোটেলে ওঠে মুসাভির। তবে আবদুল মাথিন ত্বহার ভুয়ো নাম এখনও জানা যায়নি। হোটেলে পর্যটকদের মতোই একটি রুম ভাড়া নিয়ে দুজনে আশ্রয় নেয়। রুমে ঢোকার পর থেকে আর তাদের হোটেলের বাইরে বেরতে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। এমনকী খাবারও তাদের রুমেই ডেলিভারি করতেন হোটেলের কর্মীরা।
হোটেলের কর্মীরা জানান, ২ জন হোটেল ভাড়া নেওয়ার পর আর ঘর থেকে বেরননি। নিজস্ব ছবি।
শুধু তাই নয়, অন্যান্য পর্যটকদের মত হোটেলের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড নিয়ে মাথিন ও শাহজেব ইন্টারনেটও ব্যবহার করেছিল। খাবার রুমে নিয়ে গেলে রুমের ভিতর কর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হত না। দরজা খুলে খাওয়ার হোটেল কর্মীদের থেকে নিজেরাই হাতে ধরে নিতেন। তবে দুই যুবক ঠান্ডা মাথার বলেই হোটেল কর্মীদের দাবি। কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন তবে খুব কম। এভাবে আত্মগোপনের চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি।
বৃহস্পতিবার রাত ১২টা নাগাদ রাজ্য পুলিশের সহযোগিতায় এনআইএ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী হোটেলটি ঘিরে ধরে। তারপরেই দুই কুখ্যাত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে। তার সঙ্গে তাদের সঙ্গে থাকা একাধিক ল্যাপটপ ও হোটেলের রেজিস্ট্রার খাতা বাজেয়াপ্ত করা হয় বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। দিঘায় দুষ্কৃতীদের আশ্রয় নেওয়ার পিছনে কোনও পূর্ব পরিচিতি কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
[আরও পড়ুন: ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ইজরায়েলে হামলা চালাতে পারে ইরান, ভারতীয়দের কী বার্তা বিদেশমন্ত্রকের?]
এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে গোয়ায় খুন করে প্রায় ১৩ বছর দিঘায় আত্মগোপন করে থাকা এক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছিল গোয়া পুলিশ। তাছাড়া রাজ্যের একাধিক অপরাধীও আত্মগোপনের জন্যে দিঘাকে বারবার বেছে নিয়েছে। তাই পর্যটন কেন্দ্র দিঘার নিরাপত্তার জোর দেওয়ার দাবি জানিয়েছে পর্যটক মহল। কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী সৌমেন্দু অধিকারীর প্রতিক্রিয়া, ''পশ্চিমবঙ্গ উগ্রবাদী, জেহাদি ও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিকে আশ্রয় দেওয়ার স্বর্গরাজ্য হয়েছে, তার প্রমাণ বাংলার মানুষ পেলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যকে রাষ্ট্র বিরোধী শক্তির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন, এটা বিজেপি অনেক আগে থেকে দাবি করে আসছে। আজ তা প্রমাণ হয়ে গেল। এর আগে কলকাতা থেকে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়েছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাংলা কী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।''
তৃণমূল প্রার্থী তথা জেলা সভাধিপতি উত্তম বারিক বলেন, ''দিঘা একটি পর্যটন কেন্দ্র, এখানে বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের মানুষ বেড়াতে আসেন। আধার কার্ড দেখিয়ে হোটেলের রুম ভাড়া নেয়। কোন মানুষ কোন কাজের সঙ্গে যুক্ত তা খতিয়ে দেখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আর অপরাধকে কোনওভাবেই মান্যতা দেয় না তৃণমূল কংগ্রেস। ভারতীয় জনতা পার্টি বাংলাকে বদনাম করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই তাদের কোনও কথার উত্তর দেওয়া শোভা পায় না।''