অভিরূপ দাস: পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার (Shivkumar Sharma) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শিরোনামে সন্তুর। হারমোনিয়াম, তবলা, সেতারের মতোই এক বাদ্যযন্ত্র। তা বাজানোর লোক ঘরে ঘরে নেই। একইভাবে সন্তুর তৈরির কারিগর হাতেগোনা, দামও আকাশচুম্বী। সবমিলিয়ে এ আদপেই আমগেরস্তের জিনিস নয়। মূল কারণ, একশো তারের যান্ত্রিক জটিলতা, শেখানোর লোকের অভাব ও সার্বিকভাবে সন্তুর (Santoor) সম্পর্কে কিছুটা অজ্ঞতা। দোকানে দোকানে গিটার, হারমোনিয়াম, তবলা, বেহালা, ঢোল গুচ্ছ গুচ্ছ মজুত থাকলেও সন্তুর নেই। দূরবীণ দিয়ে খুঁজেও পাওয়া মুশকিল।
নিখাদ ভারতীয় এ বাদ্যযন্ত্র কলকাতায় (Kolkata) বানান একজনই – মনোজ সর্দার। উত্তর কলকাতার লালবাজার এলাকায় তাঁদের দোকান দেশ স্বাধীনের থেকেও পুরনো। মনোজবাবুর কথায়, সন্তুর শেখার চাহিদা আগের তুলনায় বাড়লেও হারমোনিয়াম, তবলার তুলনায় অতি নগণ্য। চাহিদা কম। স্বাভাবিক ভাবেই কারিগর কম। পিছিয়ে পড়ার আরেক কারণ দামও। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের তুলনায় সন্তুরের মূল্য খানিকটা বেশি। একটা ভাল সন্তুরের দাম চল্লিশ হাজার টাকা। সেখানে হাজার দশেক টাকা ছোঁয়ালেই মেলে একটা হারমোনিয়াম। সাত-আট হাজার টাকা দিলেই চলে আসবে চকচকে গিটার।
[আরও পড়ুন: যৌনকর্মীরও ‘না’ বলার অধিকার আছে অথচ বিবাহিত মহিলার নেই! মন্তব্য দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতির]
এ শহরের ‘সন্তুর কিং’ পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, কিছু স্কুল বিলিতি মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট শেখায়। কিন্তু ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র বাদন শেখায় না। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য বহন করছে সন্তুর। বেদ-পুরাণে এই যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। পণ্ডিতজির কথায়, খাঁটি ভারতীয় এ বাদ্যযন্ত্রর সঙ্গে কি-বোর্ডের তুলনা চলে না। বর্তমানে ধীরে ধীরে মা-বাবারা সন্তুরের মর্ম বুঝতে পারছেন। ছেলে-মেয়েদের পাঠাচ্ছেন সন্তুর শেখার জন্য। কিন্তু কারিগর না থাকায় থমকে সেই শেখার ইচ্ছে। পণ্ডিতজির দশজন ছাত্র বহুদিন আগে বরাত দিয়েছেন সন্তুর। কারিগর কম থাকায় তাঁরা বিপাকে। কবে সন্তুর হাতে পাবেন বুঝতে পারছেন না।
সন্তুর বাদক চিরদীপ সরকারের কথায়, সন্তুরের চাহিদা কম থাকার নেপথ্যে রয়েছে অধ্যবসায়ের অভাব। গিটার কিংবা মাউথ অর্গানের মতো যন্ত্র ইউটিউব দেখে প্রাথমিক বাজানোর মতো করে শিখে নেওয়া যায়। কিন্তু একশো তারের সন্তুর শিখতে মনোযোগ ও সময় লাগে যথেষ্ট। সন্তুরের আরেক নাম শততন্ত্রী বীণা। একশোটা স্ট্রিং থাকে এ যন্ত্রে। শুধু বানিয়ে ফেললেই হল না, প্রতিটা রাগকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে সন্তুরে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যিক। ‘ফাইন টিউনার’, ‘গ্লাইডিং অফ নোটস’ দেওয়া থাকলে আরও মিষ্টি হয় সন্তুরের আওয়াজ। কিন্তু সেসব যোগ করবে কে? সন্তুরের কারিগর যে একজনই। কারিগর না থাকলে আগামীর শিবকুমার শর্মা, তরুণ ভট্টাচার্যরা বিশ বাঁও জলে।
[আরও পড়ুন: ‘বউবাজারে মেট্রো প্রকল্পের নকশা বদলে দিয়েছে তৃণমূল’, বিস্ফোরক দিলীপ ঘোষ, পালটা জবাব শান্তনুর]
বিদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতের চাহিদা তুমুল। পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্যর বক্তব্য, “চাহিদা বাড়ুক। তবেই কারিগর বাড়বে। সন্তুর বাজানো ভাল পেশাও হতে পারে।” মাত্র দু’ঘণ্টা অনুষ্ঠান করলে একজন উঁচুদরের শিল্পী ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পান। নতুন শিল্পী হলে মেলে ন্যূনতম পঞ্চাশ হাজার টাকা।