বিশ্বদীপ দে: মাঝে মাঝে ছেলেবেলা ফিরে আসে। সেই কবে কৈশোরের শীতের দুপুরে লেপ-কম্বলের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল একটা বই। ‘দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ’। লেখক এরিক ফন দানিকেন। বড় হয়ে জেনেছি প্রথম প্রকাশের সময় কেমন তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল এই বইটা। দানিকেনের তত্ত্বকে আজকাল লোকে আর পাত্তা দিতে চায় না। কিন্তু মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা রোমাঞ্চকে স্থায়ী ভাবে জমিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল ওই বই। চেনা পিরামিডের ভিতরেও এত রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানত! এই মহাবিশ্বে মানুষ যে একা নয়, এমন বিশ্বাস মনের মধ্যে ভেসে রয়েছে সেই থেকে। গত বছরের শেষ লগ্নে সেই বিশ্বাসকে নতুন করে সার-জল দিয়েছিল একটা খবর। সারা পৃথিবীর মানুষকে চমকে দিয়েছিল মনোলিথ (Monolith) রহস্য। আরও কত অজস্র মানুষের জীবনে যে কমবয়সের রোমাঞ্চ আবারও ফিরে এসেছিল তা গুনে শেষ করা যাবে না।
দানিকেনের থিয়োরি হোক কিংবা আসিমভ-ব্র্যাডবেরি হয়ে প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনি। অথবা ‘ইটি’, ‘২০০১: এ স্পেস ওডিসি’র মতো সব ছবি। মানুষ আসলে বরাবরই বিশ্বাস করতে চেয়েছে তারা এই ব্রহ্মাণ্ডে একা নয়। তাই বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক থেকে শিল্পী-মন সকলেই আতিপাতি খুঁজে বেরিয়েছে ভিনগ্রহী প্রাণের সুলুকসন্ধান। একেবারে যাকে বলে ‘খ্যাপা খুঁজে ফেরে…’। মনোলিথকে ঘিরেও তাই জল্পনা ক্রমশ আকাশ ছুঁয়ে ফেলতে সময় নেয়নি। প্রথমে আমেরিকার উটাহ (Utah)। তারপর রোমানিয়া হয়ে ক্রমশ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যত গজিয়ে উঠেছে রহস্যময় তিনকোনা ধাতব মনোলিথ, তত ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। কোথা থেকে আসছে এরা? তারপর রাতারাতি উধাও-ও হয়ে যাচ্ছে! ব্যাপারটা কী? এর সঙ্গে কি সত্যিই রয়েছে ভিনগ্রহীদের যোগ?
[আরও পডুন: কেমন দেখতে মঙ্গল? লালগ্রহের মাটি ছোঁয়ার আগেই ছবি পাঠাল চিনা মঙ্গলযান তিয়ানওয়েন-১]
স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘২০০১: এ স্পেস ওডিসি’ (2001: A Space Odyssey) ছবির দর্শকরা মনোলিথকে বিলক্ষণ চেনেন। সেই ছবিতে এমনই মনোলিথের দেখা মিলেছিল। এত দশক পেরিয়ে এবার খোদ ভিনগ্রহীরাই রেখে যাচ্ছে এমন তাজ্জব এক বস্তু? কিন্তু কেন? কী বার্তা দিতে চায় তারা? দাঁড়ান দাঁড়ান। কন্সপিরেসি থিয়োরিস্টরা ইতিমধ্যেই হয়তো মেনে নিয়েছেন মনোলিথের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ভিনগ্রহীদের অদৃশ্য ট্যাগকে। কিন্তু রহস্যকে হ্যাঁচকা টানে ঘুরিয়ে দিতে শুরু করেছেন অনেকেই। যাকে বলে অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। তাঁদের দাবি… একটু খুলে বলা দরকার।
টম ডানফোর্ড। বয়স ২৯। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে ‘আইল অফ উইট’-এ তাঁর বাড়ি। এই যুবকই একদিন বিকেলে কুকুরকেট নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে আচমকাই আবিষ্কার করেন সমুদ্র সৈকতে খাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে আস্ত এক মনোলিথ। প্রবল হইহই পড়ে গেল। লেখা হচ্ছিল একের পর এক রিপোর্ট। আবার ফিরে এসেছে মনোলিথ। এবার ইংল্যান্ডের… কিন্তু আচমকাই সব উত্তেজনাকে ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে ডানফোর্ডের সটান স্বীকারোক্তি, ওটা তাঁরই নিজের হাতে তৈরি! কিন্তু হঠাৎ এমন উদ্ভট খেয়াল হল কেন তাঁর?
[আরও পডুন: ভরসা মাটি-জল, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে বাংলায় হাজির বিপন্ন গ্রেট নটরা]
উত্তরে বিবিসিকে ডানফোর্ড জানাচ্ছেন, আমেরিকা, রোমানিয়া প্রভৃতি স্থানে মনোলিথের আবির্ভাবকে দেখেই তাঁর মনের মধ্যে মনোলিথ বানানোর ইচ্ছের জন্ম হয়েছে। পেশায় ডিজাইনার ডানফোর্ডের মতে, যদি ভিনগ্রহীরা পৃথিবীতে আসে তারা অবশ্যই এ তল্লাটে আসবে। কেননা করোনায় সেভাবে কাবু নয় ‘আইল অফ উইট’। কাজেই ইটিরা অতিমারীর মধ্যে নীল রঙের এই গ্রহে এলে এখানে আসতেই পারে। তবে তাঁর ধারণা ছিল, বানানোর দু’ঘণ্টার মধ্যেই এটা কেউ না কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে। তা অবশ্য হয়নি। দিনদুয়েক খুব ভিড়-টিড় হল এখানে। লোকে দেদার সেলফি তুলল। তারপর ডানফোর্ড নিজেই সরিয়ে নেন মনোলিথটি।
একই কথা শোনা গিয়েছে উটা ও ক্যালিফোর্নিয়ার মনোলিথকে ঘিরেও। ‘দ্য মোস্ট ফেমাস আর্টিস্ট’ নামের এক শিল্পী গোষ্ঠীরই শিল্পীরাই বানিয়েছেন এখানকার মনোলিথ। শোনা যাচ্ছে, রোমানিয়া ও উটার শিল্পকর্ম দু’টি নাকি বিক্রি হয়েছে ৩৪ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে। একই ঘটনা ঘটেছে ভারতেও। বছরশেষে আহমেদাবাদে হইহই পড়ে যায় মনোলিথকে ঘিরে। রীতিমতো ভিড় জমে যায়। দেখা যায় মনোলিথের গায়ে আবার রহস্যময় কী সব লেখাও রয়েছে! পরে অবশ্য রহস্যভেদ হয়ে যায়। যে পার্কে এর দেখা মিলেছিল, তারাই জানিয়ে দেয় উদ্যোক্তারাই বানিয়েছেন সাত ফুট লম্বা এই মনোলিথ! এখানেই শেষ নয়, বহু ক্ষেত্রেই রাতের বেলা মনোলিথকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শীদেরও দেখা মিলেছে। অর্থাৎ যা দাঁড়াচ্ছে, বানিয়েছে শিল্পীরা। তারপর তা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। কখনও শিল্পী নিজেই সরিয়ে নিচ্ছেন তা। অর্থাৎ অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সের চরম।
রোম্যান্টিক মন এমন আশাভঙ্গের গল্প শুনতে চায় না। তাঁদেরই উসকে দিয়েছেন ম্যাটি মো। ‘দ্য মোস্ট ফেমাস আর্টিস্ট’-এর এক সদস্য। তিনি কিন্তু দাবি করছেন, তাঁরা মোটেই কোনও মনোলিথ তৈরি করেননি। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-কে তাঁর সাফ জবাব, ”মনোলিথ আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সারা পৃথিবী জুড়ে এলিয়েনরা খেটেখুটে যে সব মনোলিথ বানাচ্ছে, তাদের আমার শুভেচ্ছা।” তবে আদতে যে ম্যাটি সিরিয়াস হয়ে এমন কথা বলেছেন, তেমন কোনও প্রমাণ নেই। সুতরাং জোর করেও কিছু প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল। তবে কিনা, বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না। আফ্রিকার মরোক্কো, ইউরোপের অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইটালি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইরান- বহু দেশ থেকেই মনোলিথের খবর এসেছে গত তিন-চার মাসে। তাদের সকলেরই রহস্য সমাধান তো হয়নি। সুতরাং এত সব নকলের মধ্যে একটিও ‘আসল’ অর্থাৎ এলিয়েন নির্মিত মনোলিথ কি থাকতে পারে না?
এর মধ্যেই আবার ঘনিয়ে উঠেছে নয়া রহস্য। মাঝে বেশ কয়েক সপ্তাহ মনোলিথের আবির্ভাবের খবর মেলেনি। কিন্তু মাত্র দিন চারেক আগেই তুরস্কের (Turkey) এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ফের দেখা মিলেছে মনোলিথের। কোথা থেকে ওই মনোলিথ ওখানে এল, তা জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে সিসিটিভি। আপাতত এই খবরেই মন এলিয়েনপ্রেমীদের। এবার যেন সত্যি সত্যি এলিয়েনেরই তৈরি হয়। আর যদি তা না হয়ও তাতেই বা কী আসে যায়? ছোটবেলা থেকে শুনে আসা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, ইয়েতি রহস্যের পর আরও যে এক চায়ের টেবিলে ঝড় তোলার খবর পাওয়া গিয়েছে সেটাই বা কম কী! ফেলে আসা রোমাঞ্চের দিনে ফিরে যাওয়ার মজা তো হরবখত পাওয়া যায় না।