সুমিত বিশ্বাস, অযোধ্যা পাহাড় (পুরুলিয়া): বৈশাখী গরমে ধুঁকছে পুরুলিয়ার পর্যটন (Purulia Travel and Tourism)। চারতারা রিসর্ট আর কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল ছাড়া পুরুলিয়ার পর্যটন কেন্দ্রের লজ, কটেজ, পর্যটক আবাস, গেস্ট হাউস, হোমস্টে'র ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অযোধ্যা পাহাড় থেকে গড় পঞ্চকোট, দোলাডাঙা থেকে বড়ন্তি। বনমহল পুরুলিয়ার পর্যটনের ছবিটা এখন এমনই। একদিকে বৈশাখের ধারাবাহিক দহনজ্বালা, অন্যদিকে ভোট। এই জোড়া ফলায় বিদ্ধ পর্যটন মহল। ফলে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যবসায়ীরা বেশ সমস্যায় পড়েছেন। ভুগছে 'সামার ট্যুরিজম'। তবে আশার আলো একটাই, নির্বাচন ও প্রখর দাবদাহের জেরে আগের বুকিং পর্যটকরা বাতিল করলেও তা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে বর্ষার মরশুমে।
শুনশান রাস্তা। ছবি: সুমিত বিশ্বাস।
পুরুলিয়ার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সাম্প্রতিক কালে ৪৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ওঠার রেকর্ড থাকলেও এই জেলার পর্যটন কিন্তু সারা বছরই হচ্ছিল। মাঝখানে কোভিড খানিকটা প্রতিবন্ধক হলেও পুরুলিয়ার ভরা গ্রীষ্মেও পর্যটক আসছিল। কিন্তু এবার তাপপ্রবাহের জেরে অযোধ্যা পাহাড়ে পানীয় জলের সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করায় সরকারি অতিথি আবাস, হোটেল, লজ, কটেজ, রিসর্টে জলের সংকট দেখা দিয়েছে। সেই জন্য ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে রাজ্যের পঞ্চায়েত গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের অযোধ্যা পাহাড়ের অতিথি আবাস।
খাঁ খাঁ করছে অযোধ্যা পাহাড়তলির মাঠা বনাঞ্চলের এক রিসর্ট। ছবি: সুমিত বিশ্বাস।
সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের অযোধ্যা পাহাড় প্রকল্পের আধিকারিক সুশান্ত খাটুয়া বলেন, "আমরা অনলাইন বুকিং বন্ধ করে দিয়েছি। অযোধ্যা পাহাড় জুড়ে জলকষ্ট শুরু হয়েছে। আমাদের পর্যটন প্রতিষ্ঠানে গভীর নলকূপ না থাকায় জল মিলছে না। কোনওভাবে জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ থেকে স্টাফ কোয়াটার জল দেওয়া হচ্ছে তাই আমাদের অতিথি আবাস এখন পর্যটক শূন্য।" একই ছবি এই পাহাড়ের একাধিক বেসরকারি পর্যটন প্রকল্প সহ হোমস্টে গুলির।
এদিকে সরকারি অতিথি আবাস আর কদিনের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ভোটের জন্য নিয়ে নেবে। এই বিষয়ে সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ অযোধ্যা পাহাড় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রশাসন একপ্রস্থ কথাও বলেছে। মূলত পর্যবেক্ষক এবং ভোটের কাজে যুক্ত থাকা কর্মীদের জন্যই সরকারি অতিথি আবাসের একটা বড় অংশ পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন বুকিং করে নেবে। বুকিং করে নেবে অযোধ্যা হিল টপের বনদপ্তরের পর্যটক আবাসও। সবে মিলিয়ে মে মাস পর্যন্ত পুরুলিয়ার পর্যটনে কার্যত তালা!
[আরও পড়ুন: ‘দাদাগিরি’, ‘দিদি নম্বর ১’-এর শুটিং স্টুডিওতে আগুন, মেকআপ ভ্যানের এসিতে বিপত্তি! ]
তবে অযোধ্যা পাহাড়ের একটি চারতারা রিসোর্ট ও কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেলে অবশ্য এই পরিস্থিতি নেই। সেখানে পর্যটকদের জন্য গ্রীষ্মকালীন নানান বিনোদনের ব্যবস্থা থাকায় সেখানে অবশ্য একেবারে উলটো ছবি। অযোধ্যা হিলটপের কচুরিরাখার ওই চারতারা রিসোর্টে আগামী মে মাসে বুকিং বেশ ভালো। তবে গত এক সপ্তাহে সেভাবে বুকিং ছিল না। একই ছবি পুরুলিয়া শহরের সিটি সেন্টারের চার তারা হোটেলেও। এই চারতারা হোটেল গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার সুদীপ্ত কুমার বলেন, " পুরুলিয়া শহরে আমাদের যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে মূলত কর্পোরেট ভিড়। যেহেতু এপ্রিল মাসের বিভিন্ন কোম্পানির নারাকম বাজেট তৈরি হয় তাই ওই প্রতিষ্ঠানে সমগ্র এপ্রিল জুড়েই বুকিং রয়েছে ।
পাহাড়ে চলতি সপ্তাহে সেভাবে বুকিং না থাকলেও স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়াই মে মাসের বুকিং রয়েছে। সেইসঙ্গে বর্ষার বুকিং শুরু হয়েছে। " তবে এই হোটেল গ্রুপের মাঠা বনাঞ্চল একেবারে পর্যটক শূন্য। পর্যটন প্রতিষ্ঠানের ফ্রন্ট অফিস এক্সিকিউটিভ সঞ্জয় গোপ বলেন, " এপ্রিল মাসটা মোটামুটি আমাদের ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু মে মাসে একদিকে ভোট ও তাপপ্রবাহের জন্য এখনও পর্যন্ত মাত্র একটা রুমের বুকিং আমরা পেয়েছি। ৩ মে ওই বুকিং রয়েছে। আর কোন বুকিং পাইনি। "
অযোধ্যা পাহাড়ের সাইট সিয়িং আপার ড্যাম পর্যটক শূন্য। ছবি: সুমিত বিশ্বাস।
ভোট ও তাপপ্রবাহের জোড়া ফলায় পুরুলিয়ার পর্যটন থমকে যাওয়ায় শুধু হোটেল শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে তা নয়। পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত গাড়ি ব্যবসা ও গাইডরা বেশ সমস্যায় পড়েছেন। গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত শংকর মাহাতো, শুভাশীষ বাগ বলেন, " বেশ কয়েক বছর ধরে পুরুলিয়ার পর্যটন সারা বছরের হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার যেন ছন্দপতন হলো। ভোট যেমন একটা কারণ তেমনি বড় কারণ ধারাবাহিক তাপপ্রবাহ। এবারের দহন জ্বালা কয়েক বছর থেকে একটু বেশি। গত দেড় সপ্তাহ ধরে পর্যটক একেবারে না আসায় গাড়ি ব্যবসায় বড়সড় ক্ষতি হচ্ছে। "
এমন জায়গায় যাচ্ছে যে ইনস্টলমেন্ট দিতে সমস্যায় পড়বেন ব্যবসায়ীরা। অযোধ্যা পাহাড়ের মোটরবাইক গাইড দুলাল কুমার বলেন, " গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে একেবারেই পর্যটক পাচ্ছি না। এমন ছবি কিন্তু গত কয়েক বছরে অযোধ্যা পাহাড়ে ছিল না। " পুরুলিয়ায় দহনজ্বালা থাকলেও অযোধ্যা পাহাড় ও গড় পঞ্চকোটে বিকালের পর আবহাওয়া মনোরম হতে থাকে। দিনের বেলায় পর্যটকরা ইনডোর কার্যক্রমে যুক্ত থাকার পর সন্ধ্যার পর বাইরে বার হন। কিন্তু গত কয়েক বছরের সেই চেনা ছবি টা এবার উধাও। ফলে এক ধাক্কায় মুখোশ বিক্রিও কমে গিয়েছে চড়িদায়। ধাক্কা খেয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি।