shono
Advertisement

বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছিল মৈনাক, ভাইয়ের কীর্তি এখনও জানেন না দিদি সৌমি

“ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার... আসবাব দামি দামি, সব থেকে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি... আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম..”৷ The post বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছিল মৈনাক, ভাইয়ের কীর্তি এখনও জানেন না দিদি সৌমি appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 03:13 PM Jun 04, 2016Updated: 09:50 AM Jun 04, 2016

সৌরভ মাজি: “ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার… আসবাব দামি দামি, সব থেকে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি… আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম..”৷

Advertisement

নচিকেতা চক্রবর্তীর এই গানের কলিই মৈনাকের বাবার মনের কথা বলছে৷ খড়গপুর আইআইটি-র কৃতী ছাত্র থেকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী গবেষক মৈনাক সরকার৷ ছেলে মস্ত মানুষ হলেও শেষ বয়সে তাঁর বাবা সত্যেন্দ্র সরকারের ঠাঁই হয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমে৷ বিক্রি করে দিলেও ছেলের বেড়ে ওঠার বাড়িটার টানে বারবার ছুটে যেতেন দুর্গাপুরের বিধাননগরে সরকারি আবাসন এলাকায়৷ ৮/২/২০ নম্বর ফ্ল্যাটটার মালিকের সঙ্গে দেখা করে ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যে অতীতকে খুঁজতেন৷ যে ঘরের মধ্যে দুই ছেলেমেয়েকে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন, সেই ঘরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতেন৷ ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে ফিরে যেতেন আবার সেই বৃাশ্রমে৷  একবুক যন্ত্রণা নিয়ে বছর তিনেক আগে মারাও গিয়েছেন তিনি৷ মৃত্যুকালেও ছেলের সান্নিধ্য পাননি তিনি৷

বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও ছেলের আর এক কীর্তি অবশ্য দেখে যেতে হয়নি সত্যেন্দ্রবাবুকে৷ ‘ব্রিলিয়াণ্ট’ ছেলে যে কাউকে খুন করতে পারে সেটা অন্তত তাঁকে আর শুনতে হয়নি৷ সুদূর আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী বাঙালি গবেষক মৈনাক স্ত্রী ও এক অধ্যাপককে গুলি করে খুন করেছে৷ তার পর আত্মঘাতী হয়েছে নিজেও৷ আর এক অধ্যাপককে খুন করার পরিকল্পনাও নাকি ছিল তার৷

তবে সে যে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না ছোটবেলায় যে শহরে বেড়ে উঠেছে মৈনাক, সেই দুর্গাপুরের বাসিন্দারা৷ যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে গোটা শহর৷ মৈনাকের বাবা দুর্গাপুরের এবিএল কারখানায় কাজ করতেন৷ দুর্গাপুরেরই বিধাননগরে সরকারি আবাসনের ফ্ল্যাটে থাকতেন৷ মৈনাক দশম শ্রেণি পর্যন্ত দুর্গাপুরের সেণ্ট মাইকেল স্কুলে পড়াশোনা করেছে৷ ১৯৯৪ সালে সেখান থেকে ৯০ শতাংশের উপর নম্বর পেয়ে পাস করে বিধানচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়৷ সেখান থেকে উচচমাধ্যমিক পাস করে মৈনাক৷ তারপর খড়গপুর আইআইটি৷ মৈনাকের দিদি সৌমিও কৃতী ছাত্রী ছিলেন৷ তিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার৷ থাকেন কলকাতায়৷

বিধাননগরে সরকারি আবাসন এলাকার সকলে মৈনাককে বুড়ো নামে চিনতেন৷ মৈনাকের ডাকনাম বুড়ো৷ পাড়ার সকলে এই নামেই বেশি চিনতেন তাকে৷ বিভিন্ন্ সংবাদমাধ্যমে ‘ভাল ছেলের’ নতুন কীর্তির কথা শুনে হতবাক তাঁরা৷ বুড়ো এই কাজ করতে পারে বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁরা৷ মৈনাকের স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকা থেকে পরিচিতরা কোনওভাবেই মেলাতে পারছেন না তাঁর দু’টি চরিত্রকে৷ কীভাবে করল মৈনাক এমন কাজ সেটাই বোধগম্য হচেছ না তাঁদের৷ মৈনাকদের বিধাননগরের ফ্ল্যাটটি কিনেছেন কলকাতার সল্টলেকের চম্পা মজুমদার ও উত্তম মজুমদার৷ শুক্রবার চম্পাদেবীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল৷ তিনি জানান, বছর বারো আগে ফ্ল্যাটটি তাঁরা কেনেন সত্যেন্দ্রবাবুর কাছ থেকে৷ মৈনাককে অবশ্য তাঁরা কোনওদিন দেখেননি৷

চম্পাদেবী বলেন, “মৈনাকের ছোটবেলার কথা বিশেষ জানি না৷ সত্যেন্দ্রবাবু ফ্ল্যাট বিক্রির পরেও প্রতি ছয়মাস অন্তর একবার করে আসতেন এখানে৷ এমআইএস তুলতে এলে ফ্ল্যাটে আসতেন৷ তাঁর সঙ্গে কথা বলেই জেনেছিলাম বৃাশ্রমে থাকতেন৷’’ কেন? চম্পাদেবী বলেন, ‘‘একবার সত্যেন্দ্রবাবু এসে জানান তিনি অসুস্হ৷ আমি বলেছিলাম ছেলের কাছে চলে যাচেছন না কেন? তখন তিনি জানান, ছেলে বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করেছে৷ ওর সংসারে গিয়ে থাকা সম্ভব নয়৷ মেয়েরও সংসার রয়েছে৷ স্ত্রী মারা গিয়েছেন, ছেলের কাছে থাকতে পারবেন না, তাই বৃাশ্রমে থাকবেন বলে ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও জানান সত্যেন্দ্রবাবু৷ খুব খারাপ লেগেছিল আমার৷ শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন শুনে৷”

তবে মৈনাক যে মেধাবী ছিল তা ফ্ল্যাট কেনার পর টের পেয়েছিলেন চম্পাদেবীরা৷ কেনার পর ফ্ল্যাট সাজানোর সময় দেখেন একটা বিছানার চাদর পড়ে রয়েছে৷ আর চাদড়জুড়ে শুধুই অঙ্কের অাঁকিবুকি৷ ভেবেছিলেন নকশাটাই বোধহয় এমন৷ কিন্তু বাথরুমে গিয়ে তাজ্জব হয়ে যান, সেখানেও দেয়ালজুড়ে শুধু অঙ্কের সমাধান করা রয়েছে৷ পরে সত্যেন্দ্রবাবুর কাছে জানতে পারেন মৈনাক করেছে ওই সব৷ পাড়ার বাসিন্দা পূর্ণিমা মাইতি, বিশ্বজিত্‍ মাইতি, মীরা দত্তরা খবর শুনে শুক্রবার হাজির হয়েছিলেন মৈনাকের বাড়ির সামনে৷ পুলিশও এসেছিল খোঁজখবর করতে৷ বিশ্বজিত্‍ মাইতি জানান, পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল৷ তার পর তো বিদেশ চলে যায়৷ বিশেষ আর যোগাযোগ ছিল না কারও সঙ্গে৷ একটা ঘটনার কথা সকলেরই মনে আছে৷ ছেলের পড়াশোনায় একফোঁটা ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য ফ্ল্যাটের কলিং বেল খুলে রাখতেন মৈনাকের মা৷ পাছে কেউ কলিং বেল বাজালে ছেলের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটে৷

তেমনই লস অ্যাঞ্জেলেসের দুঁদে গোয়েন্দারাও তদন্তে নেমে এখনও থইকূল করতে পারছেন না, ঠিক কী কারণে মৈনাক অধ্যাপক উইলিয়াম ক্লুগ ও নিজের প্রাক্তন স্ত্রী অ্যাশলে হাস্টকে খুন করলেন৷ মৈনাকের এবং হাস্টের কম্পিউটার হার্ড ডিস্ক বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ৷ তবে তার থেকে এখনও তেমন কোনও সূত্র মেলেনি৷ ফরেন্সিক পরীক্ষা হচেছ সুইসাইড নোটেরও৷ তবে পুলিশকে ভাবাচ্ছে ইউএলসিএতে অধ্যাপক ক্লুগের অফিসে পাওয়া মৈনাকের লেখা একটি ছোট চিরকুট– ‘চেক আউট মাই ক্যাট’৷ ধাঁধার উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা৷ লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকে তদন্তে সাহায্য করছে এফবিআই৷ মৈনাকের ই-মেল খোলা গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে আশা গোয়েন্দাদের৷

পুলিশ জানিয়েছে, অ্যাশলে হাস্টকে ২০১১ সালে বিয়ে করেছিলেন মৈনাক৷ তবে সেই বিয়ে এক বছরও টেকেনি৷ জোড়া খুনের একমাত্র কারণ কম্পিউটার কোড চুরি, এমনটা মনে করছেন না গোয়েন্দারা৷ কারণ খুনের জন্য এটি অত্যন্ত তুচ্ছ বলেই তাঁদের দাবি৷ স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবং ইউসিএলএ-র বেশিরভাগ অধ্যাপকই দাবি করেছেন, ক্লুগ সম্পর্কে মৈনাক যে অভিযোগ করেছেন তা ঠিক নয়৷ এখানেই ক্লুগ-মৈনাক ব্যক্তিগত শত্রূতা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন গোয়েন্দারা৷

এদিকে, মৈনাক মনে পড়িয়ে দিয়েছে ছয়ের দশকের ঠিক এমনই একটি ঘটনা৷ ১৯৬৯ সালে এমনই এক কৃতী বঙ্গসন্তান প্রসেনজিত্‍ পোদ্দার আমেরিকার বার্কলেতে তাঁর বান্ধবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ মৈনাকের মতোই মেধাবী ছাত্র বালুরঘাটের প্রসেনজিৎ খড়গপুর আইআইটি থেকে পাস করে পাড়ি দিয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারদের মক্কা আমেরিকায়৷ অদ্ভুত সমাপতন? নাকি, ভারতের ছোট শহরের মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে একেবারে আমেরিকার মতো উদার দেশে পৌঁছে মানসিক ভাবে সংস্কৃতি রপ্ত করতে পারছেন না এই মেধাবীরা, তাই তাঁদের এমন পরিণতি? ভাবাচ্ছেন প্রসেনজিৎ-মৈনাকরা৷

The post বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছিল মৈনাক, ভাইয়ের কীর্তি এখনও জানেন না দিদি সৌমি appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement