অর্ণব আইচ: ঠিকই আছে। যেমন থাকার কথা, তেমনই। মাঝেমাঝে আলমারির লকার খুলে সোনা আর হীরের গয়নাগুলিকে দেখে নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলতেন ব্যবসায়ী ও তাঁর পরিবার। প্রায় কোটি টাকার গয়না। কিন্তু কিছুদিন আগে লকার থেকে বের করে অলঙ্কাররাজি হাতে নিয়ে কেমন যেন সন্দেহ হয় গৃহকর্তার। ওজন কি হালকা হয়ে গিয়েছে?
সন্দেহ নিরসনের জন্য পত্রপাঠ জহুরির দ্বারস্থ। এবং মাথায় বাজ। সোনা-হীরে নয়, কোনও জাদুমন্ত্রে সেগুলো নিখাদ ইমিটেশনে পরিণত হয়েছে। মানে, দেখতে অবিকল একরকম নকল সোনা-হীরের গয়না রেখে আসলগুলো লোপাট করা হয়েছে লকার থেকে। তাঁর কোটি টাকার অলঙ্কারের দাম এখন সাকুল্যে হাজার টাকাও নয়!
রহস্যটা কী? রহস্য উন্মোচনের গল্প হার মানাবে যে কোনও গোয়েন্দা কাহিনিকে। একই সঙ্গে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটি হয়ে এই ‘হীরক রহস্যের’ সমাধান করেছে কলকাতা পুলিশই। যার সুবাদে লালবাজারের কৃতিত্বের মুকুটে জুড়েছে আরেকটি উজ্জ্বল পালক। কীভাবে? ডিসি (সাউথ) প্রিয়ব্রত রায়ের তত্ত্বাবধানে ও চেতলা থানার ওসি সুখেন্দু মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে দক্ষিণ কলকাতার চেতলা থানা এলাকায় ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে এহেন রত্ন উধাওয়ের ঘটনার তদন্ত শুরু হয়। চেতলা থানার আধিকারিক সন্দীপ পাল ও তাঁর টিমের সদস্যরা জানতে পারেন, চেতলার রাজা সন্তোষ রায় রোডের ওই বাড়ির প্রায় জনা দশেক পরিচারক, পরিচারিকা, রাঁধুনি, গাড়িচালকের অন্তত চারজনই আলাদা আলাদাভাবে বাড়ি থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি করে থাকেন। আর বাড়ির শিশুটিকে দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘ন্যানি’র হাত পড়েছিল লকারের ভিতরের রত্নভাণ্ডারে। পুলিশের দাবি, ঝুমা দাস নামে ওই মহিলা রীতিমতো ছক কষে দফায় দফায় লকার থেকে গয়না চুরি করে টিফিন বক্সে ভরে পাচার করেছেন। এবং সন্দেহ এড়াতে একই রকম দেখতে নকল গয়না তৈরি করিয়ে রেখেছেন লকারে। এই ধরনের চাতুরি দেখে দুঁদে পুলিশকর্তারাও তাজ্জব বনে গিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, ঝুমার বাড়ি মেটিয়াবুরুজে। মঙ্গলবার ডিসি (সাউথ) প্রিয়ব্রত রায় জানান, এই চুরির ঘটনায় পাঁচজন মহিলা-সহ ১১ জনকে চেতলা থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। প্রথম দফায় ঝুমা দাস, সমর নস্কর, সুপ্রিয়া পুরকায়েত ও সরস্বতী দাসকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হয় ঝুমার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা দাস, দিদি রুমি সিং, অশোক জানা, সনৎ ফদিকার, প্রসেনজিৎ মান্না, তন্ময় ওঝা ও মিহির রাহা। তদন্তকারীদের দাবি, মেয়ে ও দিদির সাহায্যে ঝুমা সেই গয়নার একাংশ পাচার করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে। সেই গয়না কলকাতা থেকে মেদিনীপুর হয়ে পৌঁছে যায় গিরিশ পার্কে। আর বাকি চোরাই দামী জিনিসগুলি রেখে দেন নিজেদের কাছে। পুলিশ টিম গোয়েন্দা গল্পের কায়দায় খোঁজ চালায় খাটের তলায় কাঠের বাক্সে। এমনকী, ঝুমার অন্য একটি বাড়িতে ফেলে রাখা বাতিল বালতির মধ্যে কাপড়ে জড়িয়ে রাখা রুপোর গয়না ও বস্তুও উদ্ধার করে এই টিম। পুলিশের সন্দেহ, এই চোরাই গয়নার সঙ্গে যোগ রয়েছে আন্তঃরাজ্য চক্রের। সন্ধান চলছে আরও কয়েক জনের।
পুলিশ জানিয়েছে, চেতলা এলাকার রাজা সন্তোষ রায় রোডের একটি অভিজাত বহুতল আবাসনের পুরো চারতলা জুড়ে থাকেন ওই ব্যবসায়ীর পরিবার। চেতলা থানার পুলিশের কাছে প্রথমে সোনা ও হীরের ব্রেসলেট, হীরের কানের দুল চুরির অভিযোগ দায়ের হয়। পুলিশ প্রত্যেক পরিচারক, পরিচারিকাকে জেরা করে জানতে পারে যে, বাড়িতে কাজ করার সুবাদে তাঁদের বিভিন্ন ঘরে অবাধ যাতায়াত। সব থেকে বেশি চুরির সুযোগ বাড়ির ‘ন্যানি’ ঝুমা পালের।
কিন্তু টানা জেরার মুখে পরিচারক সমর, রাঁধুনি সুপ্রিয়া ও পরিচারিকা সরস্বতী স্বীকার করেন, তাঁরাও বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরির সঙ্গে যুক্ত। ঝুমা-সহ চারজনকে প্রথমে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ক্রমে আরও সোনা-হীরের গয়না, বেশ কিছু রুপোর বাসন, সোনা ও রুপোর কয়েন, অ্যান্টিক কয়েন চুরির অভিযোগ দায়ের হয় চেতলা থানায়। পুলিশ বাড়ির সিসিটিভিও পরীক্ষা করে বেশ কিছু ক্লু পায়। একই সঙ্গে জেরার মুখে ঝুমা স্বীকার করেন যে, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাঁর ডিউটি।
তাঁর নজর পড়ে একটি আলমারির উপর, যার লকারে সোনা ও হীরের গয়না রাখেন পরিবারের লোকেরা। সুযোগ বুঝে ঝুমা আলমারি থেকে একটি একটি করে সোনা, হীরে ও রুপোর গয়না সরাতে থাকেন। যে টিফিন বক্স করে খাবার আনা হত, সেই বক্সের ভিতরই গয়না রেখে মেটিয়াবুরুজে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলে দিতেন মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ও মোল্লারগেটের বাসিন্দা দিদি রুমি সিংয়ের হাতে। কয়েকটি বস্ত তাঁরা লুকিয়ে রাখেন।
কিন্তু ঝুমা দামী সোনা ও হীরের গয়নাগুলি তুলে দেয় গার্ডেনরিচের অশোক জানার হাতে। অশোক সেই গয়না পাচার করে মেদিনীপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী সনৎ ফদিকারকে। তাঁর মাধ্যমে গয়নাগুলি হাতবদল হয় পৌঁছে যায় গিরিশ পার্কে। আর তার বদলে এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই অবিকল নকল গয়না পৌঁছে যেত ঝুমার কাছে। আলমারির লকার খুলে সেই নকল গয়না রেখে ফের চাবি জায়গামতো রেখে দিতেন ঝুমা। অশোকের সন্ধান পাওয়ার পরই কাজ সহজ হয়ে যায় পুলিশের। পুলিশ গার্ডেনরিচ থেকে অশোক ও মেদিনীপুর থেকে সনৎকে গ্রেপ্তার করার পর ক্রমে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রসেনজিৎ, তন্ময়, মিহিরকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে সোনা ও হীরের গয়না
উদ্ধার হয়।
এদিকে, বাকি চোরাই সামগ্রীর সন্ধান পেতে পুলিশ ঝুমার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ও দিদি রুমিকে জেরা করতে থাকে। শেষপর্যন্ত ঝুমাদের বাড়ির খাটের তলায় ব্যাগ ও বাক্সের ভিতর থেকে উদ্ধার হয় কয়েকটি চোরাই সামগ্রী। খবর পেয়ে পুলিশ হানা দেয় ঝুমা দাসের অন্য একটি তালাবন্ধ বাড়িতে। ওই বাড়ির ভিতর একটি বালতি দেখে সন্দহ হয় আধিকারিকদের। তার ভিতর রাখা কাপড় বের করতেই উদ্ধার হয় কয়েকটি রুপোর সামগ্রী। এছাড়াও অন্য পরিচারক ও রাঁধুনিকে গ্রেপ্তার করে উদ্ধার হয় আরও কিছু চোরাই সামগ্রী। ধৃতদের প্রথম চারজনকে ৬ জানুয়ারি ও বাকিদের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ হেপাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আলিপুর আদালত। এই ঘটনায় আরও কয়েকজন পলাতক। তাদের সন্ধানে উত্তর শহরতলি ও ভিন রাজ্যেও তল্লাশি চালানো হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।