shono
Advertisement

‘নিঃশব্দ’ ভোটারদের উপস্থিতি গুরুত্ব পেল মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে

আমেরিকার ভিতরেও আছে কিন্তু আর একটা আমেরিকা, অন্য আমেরিকা!
Posted: 09:08 AM Nov 06, 2020Updated: 09:08 AM Nov 06, 2020

রাজদীপ সরদেশাই: মার্কিন নির্বাচনের ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ (এই নিবন্ধ যখন লিখিত হচ্ছে তখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসাবের ভিত্তিতে বলছি) আদালতে গড়াবে কি না, তা স্পষ্ট নয়! তবে একটা বিষয় মানতেই হচ্ছে: ফলাফল যা-ই হোক না কেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) আরও একবার নির্বাচনে তাঁর দুর্দান্ত প্রভাব বিস্তার করে মিডিয়া ও পোলস্টারদের যারপরনাই বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচনের দিন, হিসাবমতো গণনায়, ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী তথা চ্যালেঞ্জার জো বাইডেন ৮ শতাংশ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। মার্কিন মুলুকের প্রতিটা প্রধান রাজ্যে বাইডেনের অবস্থান ছিল মজবুত। তাহলে এতজন তাবড় ভাষ্যকার ও নির্বাচন-বিশেষজ্ঞ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের গণনায় এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এতটা ভুল আন্দাজ করলেন কী করে? অনিশ্চয় এই সময়ে নির্বাচনের গতিবিধি আন্দাজ করার একটা ঝক্কি তো আছেই। সঙ্গে রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ‘মেল ব্যালট’-এর জটিলতা। সেসবের ঘাড়ে এসে পড়েছে আরও একটা জটিলতর ‘এক্স ফ্যাক্টর’: যাকে বলা যেতে পারে ‘একো চেম্বার’ বা অনর্থক ও ভিত্তিহীন পক্ষপাতপূর্ণ আসক্তি। যা বিরাজ করে তার্কিক শ্রেণির মধ্যে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় পথ দেখাতে পারে থাইল্যান্ড মডেল]

অত্যন্ত অহংকারী ও দাম্ভিক স্বভাবের ট্রাম্প জনমতের মধ্যে একটা বিভেদরেখা টেনে এসেছেন বরাবর। তাই হয়তো আমেরিকা ও বিশ্বব্যাপী লিবারাল গোষ্ঠীর মনে আশার মেঘ তৈরি হয়েছিল যে, ট্রাম্পের পরাজয় হয়তো ভালরকম ধাক্কা দেবে দক্ষিণপন্থীদের বিভাজনের রাজনীতিতে। পাশাপাশি, সমাজের মূল মানদণ্ড রূপে ফিরে আসবে শিষ্টাচার, শালীনতা। জাতি ও বর্ণবৈষম্যে জর্জরিত আমেরিকার প্রয়োজন ছিল নিরাময় স্পর্শের, প্রয়োজন ছিল এমন একজনের, যাঁর উপস্থিতিতে দুর্দিনেও শান্তির আশ্বাস থাকবে। কিন্তু ট্রাম্পের পক্ষে এই কাজ এককথায় অসম্ভব! কারণ, মেরুকরণে বা বিভাজনেই একমাত্র তিনি সিদ্ধহস্ত।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর দলের এই নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ যেমন একদিকে ‘আমাদের মতো’ বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারপাশে, তেমনই এই মনোভাবের বিরুদ্ধে অ-সমর্থনের ভ্রুকুটিও তুলছিলেন বহু মানুষ। সেসব মানুষ, যাঁরা ‘তাঁদের মতো’। এককথায়, ‘আমরা’-‘ওঁরা’ বিভাজনের প্রকরণ। যত দিন এগিয়ে আসছিল নির্বাচনের, তত এই ‘আমরা’ বনাম ‘ওঁরা’ আরও প্রকট হয়ে উঠছিল রাজনীতির পরিমণ্ডলে। যতই হোক, নির্বাচনের মতো বিষয় কখনওই কিছু সমমনস্ক বাকপটু মানুষের হোয়াট‌সঅ্যাপ চ্যাট দিয়ে নির্ধারিত হয় না। বরং সেই স্বল্প পরিধিগত গ্রুপের বাইরে যে বিপুল জগৎ, বিপুল জনতা রয়েছেন, যাঁরা নিঃশব্দে নিজেদের রায় তুলে ধরেন ব্যালট বক্সে– সেই ‘নিঃশব্দ ভোটার’-গণই হলেন ভোটের নির্ণায়ক।

এক অর্থে, সমালোচকরা যত লাগাতার বিদ্রুপ আর নিন্দা করে গিয়েছেন ট্রাম্পকে, আখেরে ততই মজবুত করে তুলেছেন তাঁর ভিত। ট্রাম্পের নিজস্ব নেতৃত্বের ধরনে প্রতিষ্ঠানের প্রতি যে-ধরনের রুক্ষ অবজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে তাঁকে যথার্থরূপে ‘অ্যান্টি-ডেমোক্র্যাটিক’ তকমা দেওয়া উচিত, এটা ঠিক। কিন্তু, কিছু মানুষ, যাঁরা, অভিজাত রাজনীতিক শ্রেণি দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘রুল্‌স অফ এনগেজমেন্ট’ বিষয়ে অধৈর্য বা বিক্ষিপ্ত-চিত্ত, তাঁরা ট্রাম্পের এহেন ভাবমূর্তির প্রতি আরও বেশি করে
বিমোহিত হয়েছেন। ঘটনা হল, বিশ্বের প্রথম সারির নেতাদের কাছে ‘উইনিং ফরমুলা’ বা সাফল্যের চাবিকাঠি হল ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তি। এটাই এখন বিশ্ব রাজনীতির ট্রেন্ড। একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র– সর্বত্র এই ট্রেন্ডের বিস্তার। সেই ট্রেন্ডেরই একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই দলেই রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি থেকে রেসেপ এর্দোগান, বরিস জনসন থেকে জাইর বলসোনারো, ভ্লাদিমির পুতিন থেকে শি জিনপিং। নিজেদের সচেতন, সুচারু ও সুঠাম রাজনৈতিক ভাবমূর্তির বশে এঁরা বিপুল গতি পেয়েছেন তাঁদের রাজনৈতিক কেরিয়ারে। এঁদের প্রত্যেকের আখ্যানও স্পষ্টরূপে একরকম– মোটা দাগ ও কড়া ডোজের ‘পপুলিস্ট’ জাতীয়তাবাদ। সেখানে জাতির পুনরুত্থানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে বটে, কিন্তু, সেই প্রতিশ্রুতি প্রতারণামূলক। তা কড়াভাষী নেতৃত্বের বাগ্মিতায় আড়াল করা।

তবুও এই শক্তিশালী নেতাদের থেকে ট্রাম্প স্বতন্ত্র। তিনি একজন চটকদার ব্যবসায়ী, যাঁর কাছে রাজনীতি হল বিরাট কোনও চুক্তি স্বাক্ষরের অনুরূপ এক মঞ্চবিশেষ। ঠিক যেন টেলিভিশন পর্দার ‘বিগ বস’ রিয়ালিটি শো, যেখানে খেলার সমস্ত কিছু হয় ও হবে তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে। যে কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ বা বিশ্বাসের প্রতি বরাবর তিনি অবজ্ঞার দৃষ্টি রেখেছেন। এমনকী, এক-এক সময়ে তাঁর নিজের দল, রিপাবলিকান পার্টির প্রতিও। আত্মমুগ্ধতার বিষয়েও তিনি মৌলিক, বিশিষ্ট। দক্ষিণপন্থী প্রতাপশালী অন্য নেতারা হয়তো একটা স্তরে নিজেদের দোষ কম-বেশি অনুধাবন করেছেন বা প্রতিষ্ঠানিক অন্তর্ঘাত ঘটানো থেকে বিরত থেকেছেন, ট্রাম্প কিন্তু সেটুকুরও ধার ধারেননি। নির্লজ্জের চূড়ামণি! ইউএস কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর লাগাতার মতবিরোধ; মিডিয়া এবং এমনকী, তাঁর কর্মীদের প্রতিও, বিরোধীসুলভ আচরণ তাঁর অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত মননের পরিচয় দেয়। নিছক ঔদ্ধত্যের বশেই টুইটারের মতো একটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘অ্যাড হক পলিসি’ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও তিনি ভাবেন, হয়তো তিনি পার পেয়ে যাবেন।

এই কোভিড অতিমারী তাঁর পরিচালনা দক্ষতা ও নির্বোধ নেতৃত্বের কদর্যতম রূপ উন্মোচিত করেছে। হোয়াইট হাউস দখল করে থাকা দেশের প্রেসিডেন্ট প্যান্ডেমিক অবস্থায় মাস্ক না-পরে বেপরোয়া মনোভাব প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়ালেন– যেখানে কিনা সমস্ত চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিক মহলের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে, অতিমারীর প্রকোপ থেকে নিজেকে ও অন্যদের সুরক্ষিত রাখতে মাস্ক ব্যবহার করার জন্য। ট্রাম্পের এহেন আচরণ কেবলই তাঁর যুক্তিহীনতার চারিত্রিক গুণটি তুলে ধরে না, একইসঙ্গে তা বিদ্বেষপরায়ণ মানসিকতারও উদাহরণ। ব্যক্তিগত অদম্যতা-বেষ্টিত বিভ্রান্তিকর এক জগতে থাকা ট্রাম্প, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের কথা কানে তুলতে নারাজ ছিলেন। যেন তিনি তাঁরই সৃষ্ট কোনও এক সমান্তরাল মহাবিশ্বে রয়েছেন, যেখানে এই ভাইরাসের কোনও অস্তিত্ব নেই!

২০২০-র আরও একটি উদ্বেগের বিষয় ‘অর্থনৈতিক মন্দা’। ট্রাম্প তাঁর বার্তায় স্পষ্ট জানান, অর্থনীতির রেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী করতে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তিনি ঢের বেশি অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী। আমেরিকায় কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যা অত্যধিক হলেও সম্ভাব্য সময়ের আগেই অপ্রত্যাশিত গতিতে মন্দা সামলে প্রাণ ফিরে পায় মার্কিন অর্থনীতি। আর্থিক অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি সম্প্রতি আমেরিকায় বেকারত্বের হারও নিম্নমুখী। আমেরিকার উদ্যোগের চেতনা একদিন জয়লাভ করবেই– একথা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিতে সমর্থ হন ট্রাম্প। তাঁর শক্তিশালী ভাবমূর্তি সেক্ষেত্রে সম্পদ ও দায়িত্বের সমন্বয়। সাধারণ মানুষ সেই নেতার প্রতি এখনও আকৃষ্ট এবং আশ্বস্ত হয়, আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। যাঁর প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব থেকে আত্মবিশ্বাস ও কৃতিত্বের আভাস পাওয়া যায়। কখনও কখনও যদিও এঁদের হাবভাবে আস্ফালন এবং অবিনশ্বরতার অাভা মাত্রা ছাড়ায়, কাজের চেয়ে কথা হয় বেশি, তবু জনপ্রিয়তা কমে না বিন্দুমাত্র। ট্রাম্পের উগ্র বক্তৃতা, তাঁর খোলামেলা বিভেদের রাজনীতি বহুধাবিচিত্র সমাজের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হলেও, যে কোনও চতুর এবং বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ মাত্রই ‘জেনোফোবিক’ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ‘শ্বেত’ মার্কিনদের ভয়কে নিপুণভাবে কাজে লাগাবেন তো বটেই।

ব্যক্তিগত কোনওরূপ পক্ষপাতদুষ্ট ভাবনার সঙ্গে আপস না করে এই বিচিত্র জন-অনুভূতি কোন পর্যায় পর্যন্ত ধারণ করা সম্ভব– কোনও জাতির মনন বিচার করার ক্ষেত্রে, তা বলা খুবই কঠিন। অদৃশ্য এক বুদ্বুদের মধ্যে আমরা অনেকেই বেঁচে আছি, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে– যেখানে আমাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের বেষ্টনীতে থাকতে থাকতে আমরা খুব সহজেই সেই বিশ্বাসের প্রবাহে বাহিত হয়ে যাই। ‘ওয়াটারগেট’ খ্যাত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড তাঁর সাম্প্রতিক বেস্টসেলার গ্রন্থ ‘রেজ’-এ ট্রাম্পের দায়িত্ববোধ সম্বন্ধে বলেছেন: ‘প্রত্যেক প্রেসিডেন্টের একটা বাধ্যবাধকতা রয়েছে, জাতীয় স্বার্থকে সংজ্ঞায়িত করা ও সুরক্ষিত রাখা তাঁদের অবশ্য কর্তব্য। জনসাধারণের সামনে সত্যি মেলে ধরাও তাঁদের একান্ত দায়িত্ব, বিশেষত সংকটজনক পরিস্থিতিতে। কিন্তু ট্রাম্প ব্যক্তিগত প্ররোচনাকে হাতিয়ার বানিয়েছেন তাঁর প্রেসিডেন্ট পদ পরিচালনা করার জন্য। একজন প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর অবদানের নিরিখে বিচার করলে একটাই পরিণাম মাথায় আসে: ট্রাম্প এই কাজের জন্য সম্পূর্ণরূপে অযোগ্য।’ উডওয়ার্ডের মূল্যায়ন ভুল নয়, কিন্তু আমেরিকার মতো বিভেদ-বিভাজনে বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্রের অনেকেই এমনটা মনে করেন না। দুর্ভাগ্যবশত, আত্মতৃপ্ত ভোট-বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী ও পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া কোনওকালেই এই কঠিন সত্যির সঙ্গে একমত হয়ে উঠতে পারেনি।

পুনশ্চ ২০১৯ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, দেশের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়ে আমি একটা সংক্ষিপ্ত ভিডিও ব্লগ করি, যেখানে আমি বলেছিলাম, সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ৩০০-র বেশি আসন দখল করবে। এই প্রসঙ্গে একজন প্রবীণ সাংবাদিক আমাকে ফোন করে বলেন, “যা দেখছি, তুমিও বিকিয়ে গেলে! দেশে অ্যান্টি-মোদি মেজাজটা কি তোমার চোখে ধরা পড়ছে না?’ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর, আমি তাঁকে একটা মেসেজ পাঠাই: ‘দেশের মেজাজ আপনাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নির্ধারিত হয় না, বরং সেই মেজাজ দেশের মাটিতে মাটিতে, পথে পথে ‘আসল’ ভারতে বিন্যস্ত।” তেমনই আমেরিকার ভিতরেও আছে কিন্তু আর একটা আমেরিকা, অন্য আমেরিকা!

[আরও পড়ুন: ক্ষুধার সূচকে অস্বস্তিতে ভারত, সত্যিই কি আমাদের অর্থনীতির হাল এত খারাপ?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement