কোয়েল মুখোপাধ্যায়: উত্তরকাশীর সংকীর্ণ সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার অভিযানের নেপথ্য নায়ক কে? উত্তর, একক কোনও নাম নয়। বিগত ১৭ দিন ধরে ৪১ জনকে জীবিতাবস্থায় উদ্ধার করার জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন অনেকে। তালিকায় রয়েছেন এনডিআরএফ, এসডিআরএফ, ভারতীয় সেনা এবং অন্যান্য রাজ্য তথা কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির কর্মীরা। আছেন স্থানীয় এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদরা। শুধু তাই নয়, বিদেশি যন্ত্র (পড়ুন অগার মেশিন) যখন দফায় দফায় বিকল হয়েছে ড্রিলিং করতে নেমে, তখন অন্তিম সময়ে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন ‘র্যাট হোল মাইনিং’ বিশেষজ্ঞরা।
সুতরাং, এ কথা স্পষ্ট যে, সামগ্রিকভাবে বিচার করলে কারও একক কৃতিত্বে কিছু হয়নি। বরং শ্রমিকদের উদ্ধারে সাফল্য এসেছে ‘সবে মিলি করি কাজ’ পথে হেঁটেই। তা, কারা কারা ছিলেন সেই তালিকায়? প্রথমেই নাম করতে হয় আইএএস অফিসার নীরজ খইরওয়ালের। সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে ধসের ঘটনায় উদ্ধারকাজের নোডাল অফিসার নীরজ। গত ১০ দিন ধরে উদ্ধার প্রক্রিয়ার গোটাটা, তিনিই তত্ত্বাবধান করছেন। পাশাপাশি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ‘আপডেট’ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় (সিএমও) এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে (পিএমও)। নীরজ রয়েছেন উত্তরাখণ্ড মন্ত্রিসভার সচিব পদে।
দ্বিতীয় নাম মাইক্রো টানেলিং বিশেষজ্ঞ ক্রিস কুপার। ক্রিসের অভিজ্ঞতা তাঁর হয়ে কথা বলে। পেশাগতভাবে তিনি একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনফ্রাস্ট্রাকটার, মেট্রো রেলের টানেল, বাঁধ, রেল এবং বিবিধ ধরনের মাইনিং প্রোজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। পাশাপাশি তিনি হৃষীকেশ কর্ণপ্রয়াগ রেল প্রোজেক্টের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা পদেও রয়েছেন। উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে ধস নামায় শ্রমিকরা আটকে পড়ার পর গত ১৮ নভেম্বর ক্রিস ঘটনাস্থলে আসেন। তার পর থেকে এখনও সেখানেই আছেন এবং উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করেন।
[আরও পড়ুন: ‘খারাপ কিছু হয়ে গেলে যে কী হত!’, উত্তরকাশীর শ্রমিকদের সামনে আবেগপ্রবণ মোদি]
তৃতীয় নাম অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সইদ আতা হসনৈন। হসনৈন এনডিআরএফ-এর সদস্য। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুড়ঙ্গে শ্রমিকদের উদ্ধারকাজের দেখাশোনা করেছেন। আগে তিনি ভারতীয় সেনার জিওসি ১৫ কর্পস-এর সদস্য ছিলেন, শ্রীনগরে কর্মরত ছিলেন।
চতুর্থ নাম আর্নল্ড ডিক্স। ডিক্স শুধু সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ নন, তিনি বিজ্ঞানী তথা গবেষকও। প্রায় প্রথম থেকেই ডিক্স উদ্ধারকাজের অংশ ছিলেন। মার্কিন অগার মেশিনের কাজকর্ম দেখাশোনা থেকে শুরু করে অনুভূমিক ড্রিলিং–সবেতেই তাঁর ভূমিকা ছিল। শ্রমিকদের উদ্ধার যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয়, তার জন্য স্থানীয় পুরোহিতদের সঙ্গে মিলে তিনি পুজোও দিয়েছেন।
পঞ্চমত, ‘র্যাট হোল মাইনার্স’। মধ্যপ্রদেশ থেকে ছজন-সহ মোট ১২ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল দিল্লি থেকে উড়ে এসেছিলেন অকুস্থলে। যন্ত্র যখন উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে, তখন এই বিশেষজ্ঞরাই আশার আলো দেখিয়েছেন। মাইক্রো ড্রিলিং থেকে ম্যানুয়াল ড্রিলিং এবং সব শেষে তার ভিতরে ৮০০ মিমি পাইপ প্রবেশ করানো– দুরূহ সব কাজ এঁরাই সামলে দিয়েছেন শেষ পর্যায়ে।
সব শেষে নাম করতেই হয় অন্য রাজ্য তথা কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির কর্মী, স্থানীয় বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, এনডিআরএফ-এসডিআরএফ এবং ভারতীয় সেনার অবদানের কথা। অকুস্থলে সব সময়ের জন্য উপস্থিত ছিলেন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাও। তাঁদের ধৈর্যেরও প্রশংসা করতেই হয়। উদ্ধারকাজ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন প্রবীণ যাদব নামে এক ভূ-গর্ভস্থ সুড়ঙ্গ-খনন বিশেষজ্ঞ, যিনি যুক্ত ‘ট্রেঞ্চলেস ইঞ্জিনিয়ারিং’ সংস্থার সঙ্গে।
প্রবীণের দাবি, ‘‘উদ্ধারে যখন কোনও প্রক্রিয়াই কাজে আসছিল না, আমি আমার সহযোগীর সঙ্গে পাইপের ভিতরে ঢুকতে অনুমতি চাই। কিন্তু বাধা দেওয়া হয়, বলা হয়-এনডিআরএফ কর্মীরা চেষ্টা করছেন। কিন্তু দেখলাম, ওই জওয়ানরা যথেষ্ট স্থূল-লম্বা-চওড়া। পাইপগুলি তুলনায় সরু। পরে সেই আমার সুযোগ এল। আমি গ্যাস-কাটার এবং জলের বোতল নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলাম। কাজ ছিল পাইপের ভিতরে ঢুকে হাত দিয়ে মেটাল গার্ডার খুঁজে, গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে বাধা সরানোর। গোটা কাজে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হচ্ছিল, যখন তখন বিপদের আশঙ্কাও ছিল। ’’ শেষপর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে জয় হল ‘জন হেনরি’-দেরই। মার্কিন লোকগাথা অনুযায়ী, জন হেনরি যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে জিতেছিলেন শুধু হাতুড়ি হাতেই।