সাবির জামান, লালবাগ: ছোট্ট গ্রামের বড় সাফল্য। কিরীটেশ্বরী মন্দিরের পর মুর্শিদাবাদের পর্যটন মানচিত্রে আরও একটি পালক যুক্ত হল সেই গ্রামের হাত ধরে। কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রকের বিচারে ‘ন্যাশনাল লেভেল ভিলেজ টুরিজম আওয়ার্ড’ জয় করল জিয়াগঞ্জ থানার মুকুন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বড়নগর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই খবরে উচ্ছ্বসিত হয়ে এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, 'এরকম রত্নসম গ্রামগুলোকে ঠিকমতো তুলে ধরলে সারা পৃথিবীর মানুষ বাংলাকে চিনতে ও জানতে পারবেন।’ বিশ্ব পর্যটন দিবস অর্থাৎ আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে রাজ্য পর্যটন দপ্তরের হাতে ওই পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।
একেবারে বাল্যবেলায় স্বামীর মৃত্যুর পর অবিভক্ত বাংলার নাটোরের মহারানি ভবানী চলে আসেন ভাগীরথী নদীর পশ্চিমপাড়ের গঞ্জ শহর আজিমগঞ্জের বড়নগরে। তখন বাংলাদেশের রাজশাহি জেলার রাজধানী ছিল এই বড়নগর। রানি ভবানী বড়নগরকে দেশের দ্বিতীয় বারাণসী হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়ে ১০৭টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তার মধ্যে অন্যতম ‘ভবানীশ্বর’মন্দির। কাশীধামেও রানি ভবানী ভবানীশ্বর নামের একটি শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। অনুমান করা হয়, কাশীধামের পরে অর্থাৎ ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে বড়নগরেও ভবানীশ্বর শিবমন্দির গড়ে তোলেন তিনি।
বিশেষ উচ্চতাসম্পন্ন অষ্টকোনাকৃতি এই মন্দিরের গম্বুজের চারধারে বারান্দা পথ একটি নিম্নগামী ছাদের দ্বারা সমাবৃত। মাথার উপর রয়েছে পদ্মের আটটি পাপড়ি। মন্দিরের খিলান, অলিন্দে তথা গোটা গা-জুড়ে চুন বালির দক্ষ নকশার পাশাপাশি একাধিক দেবমূর্তির কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে কৃষ্ণলীলা, কুবলয়পীড় বধ, মহিষাসুরমর্দিনী, রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, রাম অবতার, কল্কি অবতার প্রভৃতি। এহেন শিল্পকলা সমৃদ্ধ স্থাপত্য এবং সুপ্রসিদ্ধ টেরাকোটা শিল্পের সমাহারে নির্মাণ চার বাংলা ঐতিহাসিক মন্দির আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এলাকায় রাজরাজেশ্বরী মন্দির ছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক মন্দির।
এখানকার বালুচরি শাড়ি, কোহিতুর আম, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী পরিচালিত হোমস্টে এবং কৃষির প্রাচুর্য, প্রকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বড়নগর পর্যটকদের আকর্ষণ করে। আর এই সব কিছুকে তুলে ন্যাশনাল লেভেল ভিলেজ টুরিজম অ্যাওয়ার্ডের জন্য রাজ্য থেকে একটি প্রেজেন্টেশন পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় পর্যটন দপ্তরে। তিনটি পর্যায়ে সেখানে প্রতিযোগিতা করার পর কৃষি টুরিজম বিভাগের জন্য বড়নগর এই তকমা লাভ করে। এই তথ্য দিয়ে জেলার পর্যটন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক দেবব্রত রায় বলেন, ‘‘২০২৩ সালে একই রকমভাবে আমরা কিরীটেশ্বরীকে দেশের সেরা পর্যটন গ্রামের তালিকাভুক্ত করতে পেরেছি। আর এবার একই তকমা পেল বড়নগর।’’
প্রাচীন বাণিজ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির শহর জিয়াগঞ্জ - আজিমগঞ্জ পুরসভা লাগোয়া বড়নগর গ্রাম। ঐতিহাসিক এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভাগীরথী নদী, এক কিমি এলাকার মধ্যে পড়ে কাটোয়া-রামপুরহাট এবং কাটোয়া-মালদহ শাখার আজিমগঞ্জ সিটি ও আজিমগঞ্জ জংশন স্টেশন। আবার লালগোলা-শিয়ালদহ শাখার জিয়াগঞ্জ স্টেশনে নেমে জিয়াগঞ্জ সদরঘাট হয়ে ভাগীরথী নদী পেরিয়ে যাওয়া যায় রানি ভবানীর স্বপ্নের বারাণসী। আবার ১২ নম্বর জাতীয় সড়কের পলশন্ডাতে নেমে টোটো কিংবা অটোতে করে ৬ কিমি পথ পেরলেই পৌঁছনো যাবে দেশের সেরা পর্যটন গ্রামে। এলাকায় রয়েছে হোম স্টে, তাছাড়া আজিমগঞ্জে একাধিক অভিজাত এবং অতি আধুনিক হোটেল রয়েছে। ইতিমধ্যে পড়ুয়াদের জন্য কম খরচে অত্যাধুনিক হোটেল গড়ে উঠেছে আজিমগঞ্জে।
এই বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা তথা জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভার চেয়ারম্যান প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘বাংলার তো বটেই, জেলার মানুষ হিসাবে এই খবর আমাদের গর্বিত করেছে। প্রচারের আলোয় না থাকার কারণে বড়নগরে পর্যটকদের আনাগোনা খুব বেশি ছিল না। তবে আমরা আজিমগঞ্জ, বড়নগর এবং কিরীটেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে টুরিজম সার্কিট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এদিকে বড়নগরকে পুরসভার মধ্যে যোগ করতে পারলে এলাকায় পুর পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে। তা হলে পর্যটকরা যেমন বাড়তি সুবিধা পাবেন তেমনি কর্মসংস্থান ঘটবে বেকার যুবক-যুবতীদের।’’