সাড়ে ১১ বছর বয়সে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চাই’। ১৮ বছর বয়সে দাবায় সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গুকেশ দোম্মারাজু প্রমাণ করে দিলেন– তিনি ‘মাছের চোখ’ চেনেন। এ-ও প্রমাণ হল, খেলার প্রতি একাগ্র হলে, খেলাকে ভালবাসলে, খেলাও প্রতিদান ফিরিয়ে দেয়। ভারতের প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দের সঙ্গে কথায় বোরিয়া মজুমদার।
ডিং লিরেনের সঙ্গে ডি. গুকেশের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ১৪তম গেমটি শেষ হওয়া মাত্র ফোন ঘুরিয়েছিলাম বিশ্বনাথন আনন্দকে। বলা বাহুল্য, ফোন বেজে গেল। এই সময়টা তো আসলে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার। কাজেই ভিশি ফোন ধরতে না-পারলে নিজেকে বলার কিছু নেই। তবে মিনিট পনেরো বাদেই ফিরতি ফোন এল, বিশ্বনাথন আনন্দের কাছ থেকে। তঁার মতো শান্ত, স্থিতধী মানুষও কথা বলার সময় গলায় খুশির রেশ লুকোতে পারছেন না। বললেন, ‘আরে, ফোন টানা বেজেই যাচ্ছে! এত ফোন আসছে কী বলব!’ হয়তো আরও ফোন ঢুকে যাবে মুহূর্তে, তাই দেরি না-করে জিজ্ঞেস করে নিলাম কয়েকটি প্রশ্ন, যার কেন্দ্রে রয়েছে গুকেশের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া।
শেষ পর্যন্ত দাবায় ভারত থেকে আরও একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন উঠে এলেন। এবং এলেন রাজকীয় ভঙ্গিতে। ১৮ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! তবে কিনা ১৪তম গেমটি দেখতে দেখতে একটা সময় মনে হচ্ছিল, এটি বুঝি ড্র হতে চলেছে। তারপর গুকেশকে হয়তো খেলতে হবে ট্রাইব্রেকারে, যেখানে ডিং ফেভারিট। কিন্তু এই গেমেই ফয়সালা হয়ে গেল। আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
বিশ্বনাথন আনন্দ আমিও সত্যি ভাবিনি হার-জিতের ফয়সালা হবে এই গেমে! একটা সময় সত্যিই মনে হচ্ছিল, কারও জন্যই কিছু পড়ে নেই আর। ‘ইন অল লাইকলিহুড ইট ওয়াজ আ ড্র’। কিন্তু যখন জেতার মতো অবস্থা নেই, তখনও চেষ্টা করে যেতে হয়। এটাই যে কোনও খেলার স্পিরিট। হাল ছেড়ে দিলে হবে না। চেষ্টা করে যেতে হবে। গুকেশ সেই চেষ্টারই ফল পেয়েছে। আসলে, ও জিততে চেয়েছিল যে কোনওভাবে। সেই সর্বান্তকরণ প্রয়াসের সামনে এক সময় ডিং লিরেন ভেঙে পড়ল। স্নায়ুর চাপ সহ্য করতে পারল না। এই যে গুকেশ ‘সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ হয়ে আত্মপ্রকাশ করল, এর কারণ শুধু এই নয় যে, ও দারুণ খেলেছে, তার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে ওর অ্যাটিটিউডকেও। ওকে জেতাল ওর অ্যাটিটিউড।
ভারতীয় খেলার জগতের পরিপ্রেক্ষিতে এই জয়কে অাপনি কোথায় রাখবেন, কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
বিশ্বনাথন আনন্দ তরুণরাই যে কোনও খেলাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। গুকেশ সেটাই করেছে। যে-বয়সে ও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল, সেটা অভাবনীয়। কিন্তু আরও অনেকটা সময় ধরে গুকেশ খেলবে, ফলে অনুমান করা যায়, ওর সেরা সময় সামনে পড়ে রয়েছে। জিতে, গুকেশ, দেশের তরুণ প্রজন্মকে একটা বার্তা দিল। খেলার প্রতি একাগ্র হলে, খেলাকে চূড়ান্ত ভালবাসলে, খেলাও প্রতিদান দেয়।
ভারত থেকে একঝঁাক তরুণ দাবাড়ু উঠছে আসছে। প্রত্যেকেই তুল্যমূল্য প্রতিভার। গুকেশ ছাড়াও বলব অর্জুন এরিগাইসি ও রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দের কথা। গুকেশের এই সাফল্য যে দেশের নানা কোণে লুকিয়ে থাকা আরও অনেক প্রতিভাকে উজ্জ্বীবিত করবে, তাতে সন্দেহ নেই। আমার আকাদেমির মাধ্যমে আমি এসব তরুণ প্রতিভার সঙ্গে জুড়ে থাকতে পারছি– এটাও আমার কাছে দারুণ আনন্দের।
বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হওয়ার অাগে যতজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, প্রত্যেকে বলেছিল, গুকেশ ‘ফেভারিট’। তবে যত সহজে জিতবে বলে সবাই ধরে নিয়েছিল, তত সহজে জয় আসেনি। ডিং লিরেনের চোয়ালচাপা পাল্টা লড়াই দেওয়ার ক্ষমতায় কি আপনি অবাক হয়েছেন?
বিশ্বনাথন আনন্দ একেবারেই অবাক হইনি। ডিংকে সহজেই হারানো যাবে– এমনও ধরে নিইনি কখনও। বরং আমার মনেই হত, ডিং ঠিক সময় নিজের সেরা খেলাটা তুলে আনবে। আর, হয়েওছে তাই। এই চ্যাম্পিয়নশিপে গুকেশ ও ডিং– উভয়েই হেরেছে, আবার জিতে ফিরে এসেছে। এমন লড়াকু ও উপভোগ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ সচরাচর দেখা যায় না। ডিংয়ের জন্য একটু খারাপও যে লাগছে না তা নয়। তবে আগে যেটা বলেছি, গুকেশকে জেতাল ওর অ্যাটিটিউড। সবাই হয়তো ‘ড্র’ ধরে নিয়েই এগত, কিন্তু ও কেবল জেতারই কথা ভেবেছে। এই অ্যাটিটিউড ওর গলায় জয়মাল্য তুলে দিল।
গুকেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। অর্জুন ২৮০০ ‘এলো রেটিং’ পেরিয়ে গেল। চেস অলিম্পিয়াডে আমরা জোড়া সোনা পেয়েছি– মেন ও উইমেন সেকশন মিলিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, দাবাতে আমরা এগিয়ে চলেছি দ্রুত লয়ে, দুরন্ত ছন্দে। কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে বলে আপনি মনে করেন?
বিশ্বনাথন আনন্দ দাবায় এই বছরটা ভারতের জন্য দারুণ কাটল। তবে এই মুহূর্তে আমরা যেরকম ছন্দে রয়েছি, তা বরবার থাকবে, এমনটা তো হয় না। তবে আমি যদি ভুল প্রমাণিত হই, সবচেয়ে খুশি হব আমি নিজে। আমি যত ভুল প্রমাণিত হব, ভারতীয় দাবা তত সাফল্যের শিখরে উঠবে।