কুণাল ঘোষ: চার পুরসভায় (WB Civic Polls 2022) তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিশ্লেষণ ও আলোচনা –
১) তৃণমূলের (TMC) এই জয় প্রত্যাশিত ছিল। কারণ, রাজ্য সরকারের জনমুখী নীতি, কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতি, এ রাজ্যে প্রবল জনপ্রিয় তৃণমূল এবং বিরোধীদের ছন্নছাড়া হালে এর থেকে অন্যরকম কিছু হওয়ার ছিল না।
২) তৃণমূলের প্রার্থীতালিকা মোটের উপর ভাল। এজেন্ট দক্ষ। নির্বাচনী পরিকাঠামো চাঙ্গা। অন্যদিকে বিরোধীদের সংগঠন বলে কিছু নেই। বহু আসনে দক্ষ প্রার্থী বা এজেন্টও জোগাড় হয়নি।
৩) বিজেপি নানা অভিযোগ করছে। হাস্যকর। জয়প্রকাশ মজুমদার-সহ ওদের দলের নেতারাই বলছেন রাজ্য বিজেপির নেতৃত্ব ব্যর্থ, অযোগ্য। যেখানে দলের একাংশই নেতাদের প্রত্যাখ্যান করেন, মানুষ কেন সমর্থন করবেন? বিজেপি শুধু কম ভোটই পায়নি, চতুর্থ হয়েছে একাধিক ওয়ার্ডে।
৪) ধরা যাক বিধাননগর। যেখানে বিজেপির কোনও নেতা পাড়া বা ব্লকের পুজোয় জড়িত নন, পাড়ায় যোগাযোগ নেই, ইজেডসিসি হল ভাড়া করে দুর্গাপুজো করতে হয়, সেখানে তাঁরা স্থানীয় মানুষের ভোট আশা করেন কী করে? তৎকাল বিজেপি নেতারা শুধু আদালত, নির্বাচন কমিশন আর সস্তা নাটকে ব্যস্ত। জনসংযোগ বলে কিছু নেই।
[আরও পড়ুন: রাহানেকে নিয়ে কি লাভবান হল কেকেআর? মুখ খুললেন জুহি চাওলার মেয়ে]
৫) কিছু জায়গায় বিজেপি নেমে গিয়েছে বামেদের নিচে। বিধাননগর, চন্দনগরে ভোট শতাংশে বামেরা দ্বিতীয়। কিছু ভোট তারা পেয়েছে। বিজেপি বেহাল। যদিও প্রথম হওয়া তৃণমূলের সঙ্গে দ্বিতীয় হওয়া বামেদের দূরত্ব অনেক, তবু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা বামেদের পক্ষে তুলনামূলক ইতিবাচক। যেমন বিধাননগরে প্রথম তৃণমূলের ৭৪.১০ শতাংশের পরে বহুদূরে বামেদের ১০.৬৬শতাংশ। তবে বিজেপি আরও কম, ৮.২০%। চন্দননগরে বামেরা অনেকটা ভোট পেয়েছে। তৃণমূল ৫৯.৪২%-এর পর বামেরা ২৭.৩৭%। বিজেপি দশের নিচে। কংগ্রেস দু-একটি ওয়ার্ডে যাই ভোট পাক, মোটের উপর খারাপ। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস। দেখার বিষয়, বামেদের কিছু কিছু বিজেপিতে চলে যাওয়া ভোট সামান্য হলেও লাল শিবিরেই ফিরছে কি না। তবে এর পরিমাণ এতটাই বিচ্ছিন্ন ও কম, যে তার ভিত্তিতে বৃহত্তর রাজনীতির অঙ্ক এখনই কষা মুশকিল। এর আগে বামেদের বিপুল ভোট বিজেপির কাছে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ভোট যখন বিজেপি থেকে সরে, তখন তার অল্পই ফিরছে বামে। গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায় উন্নয়নের পক্ষে মানুষ তৃণমূলেই ভোট দিতে শুরু করছেন।
৬) বাম-কংগ্রেস (Left-Congress) জোট হোক বা না হোক, গোটাটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। শিলিগুড়িতে জোট না হওয়া নিয়ে কংগ্রেস বা বামের কেউ কেউ আফসোস করলেও ওটাতে কিছু হত না। প্রথমবার তৃণমূলকে জেতাতে মনস্থির করেই ফেলেছিল শিলিগুড়ি। অবাধ ভোটে ৪৭.২৪%, এটাই যথেষ্ট। আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়র দলবদল বিজেপিকে একটা ধাক্কা দিয়েছে তো বটেই। মানুষ অকারণ রেষারেষিকে সমর্থন না করে উজাড় করে ভোট দিয়েছেন তৃণমূলকে। অশোক ভট্টাচার্য থেকে শংকর ঘোষ, হারলেও তাঁরা কিন্তু সন্ত্রাসের অভিযোগ তোলেননি।
৭) বিরোধীরা কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন কোনও কোনও ওয়ার্ডে বা বুথে তৃণমূল কেন এত বেশি শতাংশ ভোট পেল? জবাব, তৃণমূল সরকার বা পুরসভার উন্নয়ন এবং সামাজিক স্কিমের সুফল প্রায় একশো শতাংশ মানুষই পেয়েছেন। তাহলে আশি-নব্বই শতাংশ ভোট সেই দলের প্রার্থী পাবেন না কেন? বরং তৃণমূল খতিয়ে দেখতে পারে কিছু ভোট অন্যদিকে গেল কেন? কীভাবে সেই ভোটটাও আনা যায়, দল নিশ্চয়ই সেকথা ভেবে আরও বেশি করে মানুষের কাছে যাবে। কোনও এলাকায় মানুষ যদি সন্তুষ্ট থাকেন এবং বিরোধী শিবির গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে বেশি শতাংশের ভোট তৃণমূলের দিকে তো স্বাভাবিক। মনে রাখুন, এখন সিপিএম জমানার অবাধ ভোটলুট নয়। এখন টিভি চ্যানেল, হাতে মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। কোথাও কোনও সন্ত্রাস হলে তা চাপা থাকত না। এখন হেরে গিয়ে গল্প ফেঁদে লাভ নেই।
[আরও পড়ুন: বিধায়কের নাম করে আর্থিক প্রতারণা, আপ্ত সহায়ককে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন সোহম]
৮) ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি যতটা ভোট পেয়েছিল, তা ক্রমশ কমছে। তার কারণ সমর্থকদের মোহভঙ্গ। কেন্দ্রে জনবিরোধী নীতি। এখানে রাজ্য বিজেপিতে ক্ষমতার লড়াই। অন্যদিকে তৃণমূলের উন্নয়ন ও সঠিক রাজনৈতিক লাইন।
৯) বিরোধী কেউ কেউ ভুয়া ভোটের কথা বলছেন। শান্তিপূর্ণ ভোটে ভুয়া ভোট? তর্কের খাতিরেও যদি ধরি, তাহলে ভুয়া ভোটে এত বড় জয় আসে? আর এতগুলি বিরোধী দল, তাদের এজেন্টরা বুথে আঙুল চুষছিল? পাড়ার লোককে চেনেন না? বাস্তব হল এই মুহূর্তে তৃণমূল নির্বিকল্প বলেই ভোটটা একমুখী হয়ে গিয়েছে। মানুষ শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও পরিষেবা চান।
১০) শিলিগুড়িতে প্রথমবার তৃণমূলের জয় তাৎপর্যপূর্ণ। একদা বামদুর্গ, পরে বিজেপির কিছু সাফল্য দেখা শিলিগুড়ি যেভাবে তৃণমূলকে আশীর্বাদ করেছে, তার গতিপ্রকৃতি নজর রাখার মতো।
এই ফল কয়েকদিন পরের একগুচ্ছ পুরসভার ভোটে তৃণমূলকে আরও আত্মবিশ্বাসী করবে। তবে এই চারটির ভোট যেমন শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়েছে, সেগুলিও যাতে সেরকমভাবেই হয়, সেই দায়িত্বটাও তৃণমূল নেতৃত্বের থাকবে।
আর হ্যাঁ, শুধু স্থানীয় ভোট নয়, এই ফলের রাজনৈতিক বার্তাও প্রবল। বিজেপি ভেঙে পড়ছে। আর বাংলা তৃণমূলের দুর্ভেদ্য দুর্গ। গোটা দেশেই মানুষ দেখছেন, জানছেন।