তরতাজা যুবক-যুবতী। আচমকা সব অন্ধকার, সংজ্ঞাহীন। সেকেন্ডের মধ্যে আবার ঠিকঠাক। কেন হয় এমন পরিস্থিতি? কী করবেন? জানাচ্ছেন অ্যাপেলো গ্লেনিগেলস হসপিটালের বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. বিকাশ মজুমদার। লিখছেন পৌষালী দে কুণ্ডু।
কাজ করতে করতে চোখের সামনে হঠাৎ সব অন্ধকার। অল্প মাথা ঘুরেই ধপাস। তারপর সঙ্গে সঙ্গে আবার জ্ঞান ফিরে একদম ফিট।
ক্রিকেট খেলতে গিয়ে উনিশ-কুড়ির যুবকের ক্রিজেই মৃত্যু। কর্মক্ষেত্রে ২৮ বছরের তরুণ কিংবা ৩৫-এর যুবতীর ব্ল্যাক আউট হয়ে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। বয়স্কদেরও যে এমন হয় না তা নয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য অজ্ঞান হয়ে তৎক্ষণাৎ ফের জ্ঞান ফিরে আসা এই মুহূর্তটাকেই বলে ব্ল্যাকআউট।
ব্ল্যাক আউট হওয়ার কারণ কী?
- হার্টের পেশিতে জন্মগত ত্রুটি।
- রোজ পরিমিত জল না খাওয়ার অভ্যাস থাকলে ডিহাইড্রেশনের কারণে জ্ঞান হারাতে পারে।
- ব্লাড প্রেশার আচমকা অনেকটা কমে গেলে ব্ল্যাক আউট হওয়া স্বাভাবিক।
- শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হলে ক্ষণিকের জন্য কেউ সংজ্ঞাহীন হতে পারে।
- প্রিয়জনের মৃত্যু, কোনও দুঃসংবাদ শুনে বা আকস্মিক কঠিনতম পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে না পেরেও এমন
- হতে পারে।
- এই সবক’টি কারণকেই সিম্পল ফেন্ট বা ভেসোভেগাল অ্যাটাক বলে। এগুলি প্রাণঘাতী নয়। শরীরে খুব বেশি ক্ষতিও হয় না।
- শোয়া অবস্থা থেকে দাঁড়ালে পালস রেট বেড়ে ১০০-১২০ হয়ে যাওয়া। এই সমস্যার নাম পশ্চারাল অর্থোস্ট্যাটিক ট্যাকিকার্ডিয়া সিন্ড্রোম (POTS)। কমবয়সি মহিলাদের এমন হতে পারে।
এক্ষেত্রে জ্ঞান ফেরাবেন কীভাবে
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে সোজা শুইয়ে দিন। তারপর তাঁর দুটি পা অল্প একটু উঁচু করে তুলে ধরুন। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ফিরে আসে। হার্টের কারণ বা ভেসোভেগাল অ্যাটাকের জন্য ব্ল্যাক আউট সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু ব্রেন স্ট্রোকের কারণে সংজ্ঞাহীন হলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জ্ঞান ফেরে না। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টার পর জ্ঞান এলেও শরীর দুর্বল লাগে, প্যারালিসিস হতে পারে।
- রোগীর গলার কাছে পালস না পেলে বুকের মাঝখানে নির্দিষ্ট জায়গায় ও নির্দিষ্টি ছন্দে চাপ দিয়ে সিপিআর দিতে থাকুন। বুকে ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর রোগীর মুখে মুখ ঠেকিয়ে দু’বার ফুঁ দিতে হবে। তারপর আবার ৩০ বার বুকে চাপ দিয়ে মুখে ফুঁ দিয়ে হাওয়া ভরতে থাকুন। এভাবে কয়েক সেট করতে হবে। হার্ট বন্ধ হয়ে গেলে তা ফের চালু হয়ে যাবে। এরপর জ্ঞান ফিরলে রোগীকে বাঁ পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিন। তারপর যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
[ আরও পড়ুন: সাইজ জিরোর দিন শেষ, সহজ উপায়ে বদলে ফেলুন চেহারা ]
দ্রুত টেস্ট করান
ইসিজি, ইকো-কার্ডিওগ্রাম একবার করিয়ে নিন। হার্টের সমস্যায় এমন হলে তা ধরা পড়ে যাবে। দু’তিন মাস বা ছ’মাস অন্তর ব্ল্যাক আউট হলে ধরে নিতে হবে হার্টের সমস্যা আছে। পরিবারে কারও হার্টের কারণে ব্ল্যাক আউট বা আচমকা মৃত্যুর ইতিহাস থাকলে অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে নিন। একবার এমন হওয়ার পর অনেকে সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যান বলে ডাক্তারের কাছে যান না। কিংবা গ্যাস হয়ে এমন হয়েছে বলে ব্যাপারটা তাচ্ছিলে্যর সঙ্গে উড়িয়ে দেন। যে কারণেই ব্ল্যাক আউট হোক না কেন তা অনুসন্ধান করে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া উচিত।
হার্টের অসুখে সিরিয়াস
- হার্টের অসুখ থাকলে ব্ল্যাক আউট হতে পারে। সাধারণত যারা হার্টের পেশির সমস্যা বা কার্ডিওমায়োপ্যাথি নিয়ে জন্মায় তাদের তরুণ বয়সেই ব্ল্যাক আউট হতে পারে। তাদের যে হার্টের এই অসুখ আছে তা আগে থেকে জানতে পারে না। ব্ল্যাক আউট হওয়ার পর ইসিজি রিপোর্ট অস্বাভাবিক এলে ধরা পড়ে।
- হার্টের পেশির সমস্যা থাকলে হার্ট অস্বাভাবিক ছন্দে চলতে থাকে। একে বলে ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া। এক্ষেত্রে হার্ট তিরতির করে ৩০০ বিটে চলতে থাকে। প্রতি মিনিটে হার্টের স্বাভাবিক ছন্দ ৬০-১০০। স্বাভাবিক ছন্দে থাকে তাহলে হার্ট সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করে ব্রেনে পৌঁছয়। কিন্তু ট্যাকিকার্ডিয়া থাকলে পাম্প ঠিকমতো না হওয়া ব্রেনে রক্ত না পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যায়। এই পরিস্থিতি কিন্তু প্রাণদায়ী হতে পারে। কখনও কখনও এমন ব্ল্যাক আউটের পর আর জ্ঞান ফেরে না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তরুণ-তরুণীরা। হার্টের পেশির মধে্য সোডিয়াম চ্যানেলে জন্মগত ত্রুটি থাকলেও হার্টবিট অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
হার্টে বিদ্যুৎ পাঠাবে আইসিডি
ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া বা হার্টের চ্যানেলের সমস্যা সমাধান করে ইমপ্ল্যান্টেবল কার্ডিওভার্টার ডেফিব্রিলেটর। পেসমেকারের মতো এটি একটি ছোট্ট যন্ত্র। যা রোগীর বুকের ভিতর প্রতিস্থাপন করা হয়। হৃদস্পন্দন যখন অস্বাভাবিক দ্রুত হয়ে যায় তখন যন্ত্রটি বিদ্যুৎ পাঠিয়ে হার্টের সেই অংশে শক দেয়। তাতে হৃদস্পন্দন আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। এতে ব্ল্যাক আউটের ঝুঁকি আর থাকে না। হার্টের পেশির সমস্যা আগাম ধরা পড়লে এবং ব্ল্যাক আউটের প্রবণতা বন্ধ করতে ডাক্তাররা আগেই আইসিডি বসিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
[ আরও পড়ুন: বয়ঃসন্ধিতে সন্তানকে নিয়ে সমস্যা? পরম যত্নে বশে আনুন অবুঝ কৈশোর ]
দাঁড়ালেই প্রেশার কমে!
শুয়ে থাকা বা বসা অবস্থা থেকে দ্রুত দাঁড়ালে অনেকের রক্তচাপ কমে যায়। আচমকা এই পরিবর্তনের ফল হয় ব্ল্যাক আউট। দাঁড়ালে সাধারণত ১০ মিলিমিটার রক্তচাপ কমতে পারে। কিন্তু তা যদি ২০ মিলিমিটারের বেশি কমে যায় তখনই অজ্ঞান হয়ে যায়। জল খুব কম পান করলে বা শরীরে জলের পরিমাণ কমে গেলে এমন হতে পারে। এছাড়া যাঁরা দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাঁরা নার্ভ শিথিল হয়ে যাওয়ার কারণে এমন দেহভঙ্গির পরিবর্তনে ব্লাড প্রেশার ঠিক মতো ধরে রাখতে পারেন না। এক্ষেত্রে ও POTS-এর সমস্যা থাকলে শোয়া অবস্থা থেকে একদম সরাসরি দাঁড়িয়ে না পড়ে আগে দু’এক মিনিট বসতে হবে। তারপর উঠে দাঁড়ান কিছুক্ষণ। এরপর হাঁটুন। প্রতিদিন সঠিক পরিমাণে জল পান করুন। এতেও কাজ না হলে তখন ওষুধ খেতে হয়।
কাজের চাপে ব্ল্যাক আউট হয় না
কর্মক্ষেত্রে কমবয়সিরা অজ্ঞান হলে অনেকে ভাবেন প্রচণ্ড কাজের চাপে বা মানসিক টেনশনে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। স্ট্রেসের সঙ্গে কিন্তু ব্ল্যাকআউট হওয়ার সরাসরি সম্পর্ক নেই। টেনশন, স্ট্রেস হলে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকে। তার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে অনেকে দাঁতে দাঁত লেগে খিঁচুনি হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে যায়। তারপর কিছুক্ষণ পরে আবার সব ঠিক হয়ে যায়। একে বলা হয় কনভারশন রিঅ্যাকশন। এমন হলে মনোবিদকে দেখিয়ে কাউন্সেলিং করিয়ে নেওয়া উচিত।
পরামর্শ : ৮৪২০১০৬০০৩
The post আচমকাই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছেন যুবক-যুবতীরা, কী পরামর্শ বিশেষজ্ঞের? appeared first on Sangbad Pratidin.