দু’বেলা পেট ভরে খেলেই যে শরীরে প্রোটিন ঢুকছে তা নয়। নীরোগ থাকতে খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিনের জোগান চাই। প্রোটিনের উপযোগিতা ও উৎস জানালেন পিয়ারলেস হসপিটালের বিশিষ্ট জেনারেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা: চন্দ্রমৌলি মুখোপাধ্যায়। শুনলেন সুমিত রায়।
পেট ভরেছে তো? খেয়ে তৃপ্তি মানেই শরীরে পুষ্টি মজুত এই ধারণা একেবারেই ভুল। সেটা অনেকেই বোঝেন না। তাই খাওয়ার ব্যাপারে পুষ্টির চেয়ে টেস্টি খাবারেই ঝোঁক বেশি দেখা যায়। আবার অনেকেই বুঝেও তা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু, সুস্থ থাকতে শরীরে প্রয়োজনীয় পরিপূরকের চাহিদা খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে মেটানো অত্যন্ত জরুরি। একমাত্র পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমেই সেই মাইক্রো ও ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টের ও চাহিদা মেটানো সম্ভব। শরীরে জরুরি ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট গুলির মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল প্রোটিন।
প্রোটিন চিনুন
প্রোটিন এক ধরনের অণু, যা বহু অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমন্নয়ে তৈরি। এই অ্যামাইনো অ্যাসিড দু’ধরনের হয়-এসেন্সিয়াল এবং নন এসেন্সিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড। শরীর নিজে থেকেই যে অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলি তৈরি করে সেগুলি হল নন এসেন্সিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড আর যেগুলি আমরা বাইরে থেকে খাদ্যের মাধ্যমে শরীরকে জোগান দিই সেগুলিকে বলা হয় এসেন্সিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড, যার উৎস প্রোটিন জাতীয় খাবার। শরীরে ২০ ধরনের এই অ্যাসিড রয়েছে তার মধ্যে নয়টি এসেন্সিয়াল ও এগারোটি নন এসেন্সিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড। সবকটির উপযুক্ত উপস্থিতিতেই শরীরে পর্যাপ্ত প্রোটিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
[আরও পড়ুন- ভোটে গরম মোকাবিলায় পান্তা ‘প্রেসক্রিপশন’ ডাক্তারদের]
ভুলটা কোথায় হচ্ছে?
পেট ভরানোর জন্য যেসব খাবার আমরা খাই তার বেশিরভাগই কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার। যেখানে প্রোটিনের মাত্রা খুব কম থাকে। যেমন ভাত, রুটি, মুড়ি, পরোটা, লুচি, চাউমিন ইত্যাদি। এতে শরীরে কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা মিটলেও প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত প্রোটিনের চাহিদা মেটে না। শরীরে সবকটি এসেন্সিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড পৌঁছায় না। ফলে শরীরে উপস্থিত নন এসেন্সিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলির সঙ্গে এই এসেন্সিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিডের যোগসূত্র অসমাপ্ত থেকে যায়। তাই শরীরে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ হয় না।
প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা
সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তন্ত্র, কোষ এবং প্রয়োজনীয় অণুর কার্যকারিতা ঠিক রাখতে প্রোটিন অত্যন্ত জরুরি। প্রোটিনের ৫টি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল—
১. প্রোটিন শরীরের গঠনের অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। যা শরীরের প্রতিটি কোষকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখতে সাহায্য করে।
২. মাংসপেশী এবং স্নায়ুর স্বাভাবিক গতিবিধি বজায় রাখতে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে সিগন্যাল সঠিকভাবে পাঠাতে প্রোটিনের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। যা বিভিন্ন হরমোনকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে।
৩. শরীর থেকে রক্তক্ষরণ আটকায়, রক্ত জমাট বাঁধে(ব্লাড ক্লট) ও শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে প্রোটিন জরুরি।
৪. আমাদের হার্টে অক্সিজেন পৌঁছায় একটি প্রোটিনের মাধ্যমে, যার নাম হিমোগ্লোবিন।
৫. শরীরের রোগ প্রতিরোধক তন্ত্রে কোনও অ্যান্টিজেন (রোগ উৎপন্নকারী জীবাণু—যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস) প্রবেশ করলে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা এই জীবাণুকে রোধ করে। এই অ্যান্টিবডিও একটা প্রোটিন।
[আরও পড়ুন-ফেয়ারনেস ক্রিম আসলে দাদের মলম! কী বলছেন বিশেষজ্ঞ?]
কার জন্য কত?
একদিনের প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা (গ্রাম)/বডি ওয়েট (কেজি)
বয়স পুরুষ মহিলা
৬ মাস ১.১২ ১.১২
৩ বছর ০.৭৫ ০.৭৬
৫ বছর ০.৬৯ ০.৭১
১০ বছর ০.৭৫ ০.৭৪
১৫ বছর ০.৭১ ০.৬৯
১৮—২৯বছর ০.৬৬ ০.৬৬
৩০—৫৯ বছর ০.৬৬ ০.৬৬
৬০—এর ঊর্ধ্বে ০.৬৬ ০.৬৬
সোর্স : ডব্লিউএইচও (হু)—এফএও রিপোর্ট
ওজন বুঝে প্রোটিন মেপে
শারীরিক অবস্থা একদিনে প্রোটিন- গর্ভবতী মহিলা ৭৮ (গ্রাম)। প্রসবের ৬ মাস অবধি ৭৪ (গ্রাম)। প্রসবের পর ৬ মাস থেকে এক বছর অবধি ৬৮ (গ্রাম)। সাধারণভাবে মাপকাঠি হল যার ওজন কেজিতে যত তার শরীরে ঠিক তত গ্রামই প্রোটিন প্রয়োজন। অর্থাৎ কারও ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, তার শরীরে দিনে ৬০ গ্রাম প্রোটিন জরুরি। এর মূল কারণ হল যে খাদ্যে যত গ্রাম প্রোটিন উপস্থিত তার পুরোটাই শরীরে শোষিত হয় না। প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনে খাটনি (কম ঘুম, কায়িক পরিশ্রম বেশি ইত্যাদি) কত তার উপর নির্ভর করে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা। তিন রকম অবস্থায় এই প্রোটিনের প্রয়োজনীতার হেরফের হয়।
যাঁদের কিডনির সমস্যা, তাঁদের কম প্রোটিন খাওয়া উচিত (৬০ কেজি বডি ওয়েট হলে ৪০—৪৫ গ্রাম প্রোটিন)। যাঁরা খুব শারীরিক পরিশ্রম করেন যেমন মাটি কাটা বা যাঁরা খুব এক্সাসাইজ বা খেলাধুলো করেন তাঁদের একটু বেশি প্রোটিন খাওয়া প্রয়োজন।যাঁরা অসুস্থতার কারণে শারীরিকভাবে খুব দুর্বল থাকেন তাঁদের একটু বেশি প্রোটিন খাওয়া দরকার।
কোন খাবারে কত প্রোটিন
অনেকের এ ধারণা রয়েছে নিরামিষ খেলে শরীরে প্রোটিনের পূর্তি হয় না নিচের তালিকা, সেই অনুমানকে ভুল প্রমাণ করবে
খাবার প্রোটিন (মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম)
মুরগির ডিম ১৩.৩
হাঁসের ডিম ১৩.৫
খাসির মাংস ২১.৪
মুরগির মাংস ২৫.৯
কাতলা মাছ ১৯.৫
চিংড়ি মাছ ১৯.১
কুচো চিংড়ি ২০.৫
বাটা মাছ ১৪.৩
ট্যাংরা মাছ ১৯.২
ইলিশ মাছ ২১.৮
গরুর দুধ ৩.২
ছানা ১৮.৩
মাসরুম ৩.১
রাজমা ২২.৯
কাঁচা ছোলা ১৭.১
ছোলার ডাল ২০.৮
মসুর ডাল ২৫.১
কাঠ বাদাম ২০.৮
কাজু বাদাম ২১.২
পোস্ত ২১.৭
সয়াবিন ৪৩.২
সেদ্ধ চালের ভাত
(মিলে ছাঁটা) ৬.৪
সেদ্ধ চালের ভাত ৮.৫
(ঢেঁকি ছাঁটা)
গম ১১.৮
সোর্স : ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউট্রিশন, আইসিএমআর
প্রোটিনের অভাবে
চুল পড়ার সমস্যা, গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে যায়, পেটে জল জমে ফুলে ওঠে, পায়ের গোড়ালিতে জল জমে ফুলতে থাকে, ফুসফুসে জল জমতে পারে, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারে, হঠাৎ রক্ত ধমনীতে জমাট বেঁধে যেতে পারে, প্রচণ্ড ক্লান্তি ভাব, হাড় বেরনো, দুর্বল চেহারা।
সাবধানতা
প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য অনেকে আজকাল বাজারের প্রোটিন মিক্স পাউডার খান। কিন্তু এগুলোর মধে্য বেশির ভাগগুলোই কোনও ওষুধ কোম্পানি বানায় না বা স্বীকৃত সুপারিশ ফর্মুলা নয়। এগুলো খাওয়ার ফলে কিন্তু অনেক সময় শরীরে বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দিতে পারে। অনেক সময় যাঁরা মদ্যপান করেন তাঁদের ধারণা যে মদ্যপানের সঙ্গে বেশি প্রোটিন খাওয়া উচিত। তা কিন্তু নয়, বরং ওই প্রোটিন সাধারণত যে রূপে খাওয়া হয় (ভাজা) তাতে শরীরে মেদ জমে বেশি।জাঙ্ক ফুড বা ফাস্ট ফুডে প্রোটিন যে রূপে খাওয়া হয়, তাতেই প্রচুর পরিমাণে নুন এবং ফ্যাট শরীরে প্রবেশ করে।স্বাদ ভাল লাগার ফলে অনেক সময় শুধু প্রোটিনই খাওয়া হয়, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রোটিন শরীরের ক্ষতি করে। শরীরে প্রোটিনের জোগান ঠিক রাখতে সেদ্ধ, অল্প তেলে বাড়িতে রান্না করা প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান।
The post খেয়ে তৃপ্তি মানেই শরীরে পুষ্টি নয়, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? appeared first on Sangbad Pratidin.